গুমসংক্রান্ত কমিশনের প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে গত শনিবার জমা দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে গুমের ঘটনায় নির্দেশদাতা হিসেবে শেখ হাসিনার সম্পৃক্ততা পাওয়ার কথা জানানো হয়েছে এবং র্যাব বিলুপ্তির সুপারিশ করা হয়েছে।
এই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে গুম, নির্যাতন ও খুনের ভয়াবহ বর্ণনা।
প্রতিবেদনে গুমের পদ্ধতি, প্রক্রিয়া এবং যে পদ্ধতিতে এগুলো কার্যকর করা হয়েছে, সেগুলো তুলে ধরা হয়েছে। কমিশনের মূল্যায়নে দেখা গেছে, বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক গুমের ঘটনা মূলত পুলিশ বিভাগের অধীনে কাজ করা বিভিন্ন ইউনিট দ্বারা সংঘটিত হয়েছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়েছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব), গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) এবং সন্ত্রাসবিরোধী ও আন্তঃদেশীয় অপরাধ (সিটিটিসি) বিভাগ। ভুক্তভোগী, সাক্ষী এবং পরিবারের সদস্যদের মতে, এই বাহিনীগুলো বেশির ভাগ গুমের জন্য প্রধানত দায়ী।
এ ছাড়া, আরও কিছু সংস্থার নাম উঠে এসেছে, যার মধ্যে রয়েছে—ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই) এবং ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স (এনএসআই)।
কমিশন ১ হাজার ৬৭৬টি নথিভুক্ত অভিযোগের মধ্যে প্রাথমিকভাবে ৭৫৮টি অভিযোগ পর্যালোচনা করেছে। এই পর্যালোচনার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হয়েছে:
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, গুমের এই সংস্কৃতি ১৫ বছরের মধ্যে এমনভাবে পরিকল্পিত ছিল, যাতে তা সহজে শনাক্ত করা না যায়। উদাহরণস্বরূপ, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা প্রায়ই সাদাপোশাকে কাজ করতেন এবং নিজেদের কর্মকাণ্ড অন্য কোনো সংস্থার ওপর চাপিয়ে দিতেন। যেমন—ডিজিএফআই যদি কোনো অভিযান পরিচালনা করত, তারা দাবি করত তারা র্যাব; র্যাব হলে বলত তারা ডিবি।
নিরাপত্তা বাহিনী প্রায়ই ভুক্তভোগীদের নিজেদের মধ্যে হস্তান্তর ও বিনিময় করত। একটি বাহিনী অপহরণ করত, আরেকটি আটক রাখত এবং তৃতীয়টি হয় হত্যা করত বা মুক্তি দিত।
একটি উদাহরণ হলো, এক ভুক্তভোগীর কল রেকর্ডে দেখায় যে, অপহরণের পরপরই তাঁর সিম কার্ড ডিজিএফআইয়ের সদর দপ্তরে সক্রিয় ছিল। প্রথম অবস্থান ডিজিএফআইয়ের একটি গোপন আটক কেন্দ্রে ছিল, পরে তাঁকে র্যাবের বিভিন্ন আটক কেন্দ্রে স্থানান্তর করা হয় এবং কয়েক মাস পর র্যাব–৭ তাঁকে গ্রেপ্তার দেখায়।
কিছু ক্ষেত্রে একটি বাহিনী এককভাবে গুম কার্যক্রম পরিচালনা করলেও সেই অপারেশন উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিভক্ত করা হতো। অপহরণের জন্য একটি দল, আটক রাখার জন্য আরেকটি দল এবং হত্যা বা মুক্তি দেওয়ার জন্য আরেকটি দল দায়িত্ব পালন করত। ফলে যারা হত্যা কার্যক্রমে সরাসরি জড়িত ছিল, তারাও প্রায়ই জানত না কাকে হত্যা করা হচ্ছে।
বাহিনীর মধ্যে প্রায়শই কাজের এলাকা এবং দায়িত্বের সীমারেখা অস্পষ্ট ছিল। উদাহরণস্বরূপ, র্যাব–২ সহজেই র্যাব–১১–এর এলাকায় অভিযান পরিচালনা করতে পারত, যা বাহিনীর অভ্যন্তরে কোনো প্রশ্ন তুলত না।
এই পরিকল্পিত অপারেশনাল জটিলতার কারণে অনুসন্ধানে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে কমিশনকে। তবে, বেঁচে থাকা ভুক্তভোগীদের সাহস এবং তাঁদের তথ্য প্রদানের মাধ্যমেই এই ব্যবস্থা কিছুটা উন্মোচন করতে পেরেছে কমিশন।
অপহরণ, আটক, নির্যাতন, হত্যা এবং মুক্তি
অপহরণ
অনুসন্ধান অনুসারে, অপহরণ সাধারণত রাস্তায় বা বাড়িতে সংঘটিত হতো, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাতে। অপহরণকারীরা প্রায়ই সাদাপোশাক পরিহিত থাকত এবং নিজেদের পরিচয় দিত ‘প্রশাসনের লোক’, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ডিবি অথবা র্যাব হিসেবে। যেসব ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীদের তাঁদের বাড়ি থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল, সেসব ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যরা গভীর মানসিক আঘাত পেয়েছিলেন, কারণ তাঁরা দেখেছিলেন কীভাবে তাঁদের প্রিয়জনদের মারধর করে ও জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রে অপহৃতদের আর কখনোই খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এ ছাড়া, ফেরি, রাস্তার পাশ অথবা অন্যান্য জনবহুল স্থান থেকেও ভুক্তভোগীদের অপহরণ করা হয়েছে। অপহরণের সময় তাঁদের নাম ধরে ডাকা হতো এবং দ্রুত বড় গাড়িতে তুলে নেওয়া হতো। গাড়ির ভেতরেই ভুক্তভোগীদের চোখ বাঁধা, হাতকড়া পরানো এবং অস্ত্রের মুখে হুমকি দেওয়া হতো। প্রায়শই নির্যাতন যেমন: মারধর বা বৈদ্যুতিক শক দেওয়া, আটকের সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে যেত।
কিছু অপহরণ জনসমক্ষে ঘটেছে, আবার কিছু ক্ষেত্রে প্রত্যন্ত স্থানে কোনো প্রত্যক্ষদর্শী ছাড়াই অপহরণ সংঘটিত হয়েছে, যার ফলে প্রমাণ সংগ্রহ করা অত্যন্ত কঠিন হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, এক ভুক্তভোগী, যিনি বেঁচে ফিরে এসেছিলেন, উল্লেখ করেছেন, ‘আমি তার সঙ্গে চা খেয়েছিলাম এবং সে বাড়ি ফিরছিল। পনেরো মিনিট পরে আমি রাস্তার পাশে তার সাইকেল এবং বই পড়ে থাকতে দেখলাম।’
যাঁরা বেঁচে ফিরেছেন, তাঁদের সাক্ষ্য এবং পরিস্থিতির ভিত্তিতে কিছু অপহরণের ঘটনার বর্ণনা পাওয়া সম্ভব হয়েছে।
আটক
ভুক্তভোগীদের বিভিন্ন সময়ের জন্য আটক রাখা হতো ৪৮ থেকে ৬০ ঘণ্টা, কয়েক সপ্তাহ বা মাস এবং কিছু ক্ষেত্রে আট বছর পর্যন্ত। সাধারণ ধারণা ছিল যে ভুক্তভোগীদের কেবল গোপন কারাগারে রাখা হয়, কিন্তু বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের সাক্ষ্য থেকে জানা গেছে, অনেককে বৈধ বন্দীদের সঙ্গে একই সেলে আটক রাখা হয়েছে।
অন্যদিকে, একই স্থাপনার ভেতরেই তাঁদের অবৈধ সেল থেকে বৈধ সেলে স্থানান্তর করা হতো। এসব স্থানান্তর সাধারণত আদালতে হাজিরার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে করা হতো, যেন তাঁদের অবৈধ আটকের বিষয়টি আড়াল করা যায়।
তদন্তে দেখা গেছে, অনেক গোপন আটককেন্দ্র এখনো অক্ষত রয়েছে, যদিও কিছু ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর অফিসগুলো পরিদর্শনের সময় এসব কেন্দ্রে আটক ব্যক্তিদের অবস্থান নির্ধারণে ভুক্তভোগীদের বিবরণ কাজে লাগিয়েছে কমিশন।
নির্যাতন
নথিভুক্ত নির্যাতনের বর্ণনা নির্মম এবং পদ্ধতিগত। বেসামরিক বাহিনীর (যেমন: ডিবি বা সিটিটিসি) পরিচালিত কেন্দ্রগুলোতে নির্যাতন তাদের দৈনন্দিন কার্যক্রমের অংশ ছিল। এসব নির্যাতন স্থানীয় অফিসেই ঘটত এবং প্রায়শই বিশেষায়িত সরঞ্জাম ব্যবহার করা হতো।
অন্যদিকে, সামরিক বাহিনী (যেমন র্যাব বা ডিজিএফআই) পরিচালিত কেন্দ্রে নির্যাতনের জন্য বিশেষায়িত অবকাঠামো ছিল। এসব কেন্দ্র প্রায়ই সাউন্ডপ্রুফ কক্ষ এবং বিশেষ যন্ত্রপাতি দিয়ে সজ্জিত ছিল। এগুলো শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের জন্য তৈরি করা হয়েছিল।
এক ভুক্তভোগী উল্লেখ করেছেন, ২০১০ সালে তাঁকে ধানমন্ডি থেকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তাঁকে একটি ঘরে নিয়ে গিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই তার ঠোঁট সেলাই করা হয়েছিল, কোনো অ্যানাস্থেটিক ব্যবহার (অবশ) না করেই। তিনি এই অভিজ্ঞতাকে ‘গরুর চামড়া সেলাই করার মতো’ বলে বর্ণনা করেছেন।
হত্যা
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে, গুম হওয়া ব্যক্তিদের হয় হত্যা করা হয়েছে অথবা তাঁদের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে আটকে রাখা হয়েছে। যাঁদের হত্যা করা হয়েছে, তাঁদের মরদেহ সিমেন্টের ব্যাগ বেঁধে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছে।
কিছু ক্ষেত্রে সামরিক কর্মকর্তা এবং সৈন্যরা সরাসরি এসব হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, এক র্যাব কর্মকর্তা বর্ণনা করেছেন কীভাবে একটি ‘অভিষেক’ সেশনের সময় তাঁর সামনে দুটি ভুক্তভোগীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল।
মুক্তি
যারা বেঁচে ফিরেছেন, তাঁরা কমিশনের তদন্তের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের উৎস। তবে মুক্তি পাওয়া ভুক্তভোগীদের ওপর মিথ্যা অভিযোগ আরোপ করা হয়েছে এবং তাদের নির্যাতনের বিষয়টি ঢাকতে মিডিয়ায় মিথ্যা গল্প প্রচার করা হয়েছে।
বেঁচে ফিরে আসা ব্যক্তিদের সাক্ষ্য অনুসারে, তাঁদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করা হয়েছে এবং স্থানীয় আইন ও বিচারব্যবস্থার ফাঁদে ফেলে দীর্ঘ সময় ভোগান্তির শিকার করা হয়েছে।