হোম > মতামত > উপসম্পাদকীয়

শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই

স্বপ্না রেজা

একজন প্রবীণ শিক্ষাবিদ একটা ঘটনার কথা বললেন। বাস্তব সত্য ঘটনা। ঘটনা বলার সময় তিনি ভারাক্রান্ত ছিলেন। ঘটনাটি এমন যে সম্প্রতি এক সেমিনারে তিনি আমন্ত্রিত প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। বক্তব্য প্রদানের আগে তিনি ছাত্রদের উদ্দেশে জানতে চাইলেন, কে কে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে পড়াশোনা শুরু করেছে, তারা যেন হাত তুলে এর উত্তর প্রকাশ করে। তিনি লক্ষ করেন, কেউ আর হাত তুলছে না। শিক্ষাবিদ বিস্মিত হলেন। এমন পরিস্থিতি তিনি তাঁর শিক্ষাজীবনে কখনোই দেখেননি। কিছুক্ষণ নির্বাক থাকলেন। তারপর জানতে চাইলেন, শিক্ষার্থীদের হাত কেন নিচে, কেন ওপরে উঠছে না।

উপস্থিত শিক্ষার্থীদের একজন বলল, ‘স্যার, আমরা কেউ এখন পড়াশোনা করছি না। আমরা দেশ গড়ার কাজে ব্যস্ত। দেশ ঠিক হলে তারপর আমরা ক্লাসে ফিরব।’ একে একে উপস্থিত সব ছাত্র এই কথার প্রতি সমর্থন জানাল। শিক্ষাবিদ বলেছিলেন, শিক্ষিত ও সুনাগরিক হতে হয় দেশ গড়ার জন্য। অভিজ্ঞতাও লাগে। শিক্ষার তো গুরুত্ব রয়েছে। পড়াশোনা না করলে কী করে তা হবে? তা ছাড়া সময়মতো পড়াশোনা শেষ না করতে পারলে তো চাকরির বয়স ও এনার্জি পাওয়া যাবে না। সবকিছুরই তো একটা সময় থাকে।

শিক্ষাবিদ মহোদয় শেষের কথাগুলো মনে মনে বলেছেন। প্রকাশ করতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন বৈকি—কাকে কী বলবেন, কে কীভাবে নেবে আর কেউ কী প্রতি উত্তর দেবে। তাতে লজ্জিত হওয়ার কোনো শঙ্কা থাকে কি না আবার। তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছে অনেকের। এ কথা না বললেই নয় যে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর এ দেশের কোনো কোনো জায়গায় শিক্ষকদের লাঞ্ছিত হতে দেখা গেছে, যা অনাকাঙ্ক্ষিত বলা যায়। ছাত্ররা জোর করে শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য করিয়েছে। অপদস্থ ও অপমানিত হয়ে স্ট্রোক করে শিক্ষকের মৃত্যুর মতো ঘটনাও ঘটেছে। শিক্ষকদের প্রতি ছাত্রদের এহেন আচরণ নিয়ে সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।

এ ধরনের আচরণের সঙ্গে সমাজ পরিচিত ছিল না বলেই অনেকে মনে করেন। কারণ, শিক্ষক একজন ছাত্রের কাছে সেই ব্যক্তিত্ব, যাঁর পদধূলিকে ছাত্ররা আশীর্বাদ বলে বিশ্বাস করে আসছে যুগ যুগ ধরে। বলা যায় জ্ঞানবুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই। গুরুদক্ষিণার সূত্রপাত সেই বিশ্বাস থেকেই। বাবা-মায়ের পর একজন ব্যক্তি শিক্ষককেই মর্যাদার আসনে বসান। বই, পুস্তক, সংস্কৃতি, কৃষ্টি, ঐতিহ্যে তারই অস্তিত্ব পরতে পরতে। একজন ব্যক্তির ভুল হতে পারে, কিন্তু তিনি যখন একটি বিশেষ পরিচিতির আবরণে ও আসনে থাকেন, তখন তাঁকে সেই অনুপাতেই মূল্যায়ন ও বিবেচনা করা বাঞ্ছনীয়। শিক্ষক হলো তেমন একটি অবস্থান, যাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভক্তি একটি চিরন্তন বিষয় হিসেবে সমাজে গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে আসছে। মানুষ গড়ার কারিগর তাঁরা। যদিও দিনে দিনে তা রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচারিতায় ফিকে হয়ে উঠেছে। যাহোক, আচমকা শিক্ষকদের প্রতি ছাত্রদের বিমাতাসুলভ আচরণ সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে বলে অনেকেই মনে করেন।

একজন অতি সাধারণ ব্যক্তি বলছিলেন, কোটাবিরোধী আন্দোলন করেছিল ছাত্ররা মেধার যোগ্যতায় সরকারি বিসিএস চাকরি পাওয়ার দাবিতে। বিষয়টি ছিল মূলত শিক্ষাসংক্রান্ত। অর্থাৎ শিক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রকৃত মেধাসম্পন্নরাই যোগ্যতাবলে চাকরির সুযোগ পাবে, এমনটাই ছিল অন্তর্নিহিত দাবি। ছাত্ররা তাই কোটার বিরোধিতা করেছিল। ছাত্রদের এই দাবিকে গোটা দেশের সাধারণ মানুষ সমর্থন করেছিল। কারণ, সেটাই হওয়া উচিত। উন্নয়নশীল একটি দেশের জন্য উপযুক্ত শিক্ষা ও দক্ষ, যোগ্য ব্যক্তির কোনো বিকল্প নেই। অপরাজনীতি, অপসংস্কৃতি, অর্থবিত্ত যোগ্যতাকে ধূসর করেছে দিন দিন। অযোগ্যতাকে আশ্রয় ও প্রশ্রয় দিয়েছে। সাধারণ অভিজ্ঞ, জ্ঞানী ও শ্রমজীবী মানুষ এর অবসান চেয়েছে, মুক্তি চেয়েছে। অনেকেই ভেবেছে অন্যায় ও অসংগতির দিন শেষ হবে। একটা সার্বিক সুষ্ঠু ও সুস্থ শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন ঘটবে এবং সেটা অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে। আর উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তি তাঁর মেধাবলেই রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল পদে অধিষ্ঠিত হবেন। ২০২৪-এর জুলাইয়ে এমন একটা আশার আলো জ্বলে উঠলেও তা যেন প্রজ্বলিত হয়ে থাকতে পারেনি বেশি দিন। কোথায় যেন ফাঁক রয়ে গেছে। শিক্ষাব্যবস্থাকে নিয়ে তেমন কোনো অর্থবহ ও কার্যকরী উদ্যোগ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দেখা যায়নি, যেখানে অন্য বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়েছে। কিংবা প্রাধান্য থাকলেও তার ওজন ছিল অত্যন্ত কম, এমনটাই মনে করেন কেউ কেউ। একজন ব্যক্তি রসিকতা করে বলছিলেন, এ দেশে ছাত্র আন্দোলন করে মন্ত্রী সমতুল্য উপদেষ্টা হওয়া যায় অতি সহজে, যেমনটা বিগত বছরের রাজনৈতিক দলগুলোয় ক্ষমতা ও প্রভাবশালীর দৌড়ে হতে দেখা যেত। ক্ষমতায় আসীন থাকার জন্য কোনো কোনো ব্যক্তিকে খুশি করে রাখার চর্চা ও বিধানের বেশ প্রচলন আছে বাংলাদেশের মতো একটা উন্নয়নশীল দেশে। খুব যেন সহজ একটা ব্যাপার এসব! এমনকি আন্দোলন করে সরকারি প্রটোকলও পেতে দেখা গেছে কাউকে কাউকে। আগে রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা যা করত, এখনো সেটাই হচ্ছে বলে অনেকে হতাশ। শুধু ব্যক্তি ও প্ল্যাটফর্ম বদলেছে। একই ধরনের আচরণ ও সিস্টেমের পুনরাবৃত্তি হলে সংস্কার হবে কী করে, এমন সংশয় ও প্রশ্ন কারও কারও।

একটা রাষ্ট্রের উন্নয়ন, সুরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত শিক্ষা ও শিক্ষাব্যবস্থা। প্রয়োজন উপযুক্ত শিক্ষার পরিবেশ। শিক্ষার্থীরা শিক্ষাঙ্গনে গিয়ে নিয়মিত শিক্ষা গ্রহণ না করলে, শিক্ষকেরা পাঠদানের সুযোগ না পেলে শিক্ষার পরিবেশ সক্রিয় হয়ে ওঠে কী করে? আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় যে কমবেশি সবাই যেন শিক্ষা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। শিক্ষা গ্রহণের চেয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে এখন রাষ্ট্র সংস্কারের কাজটি মুখ্য হয়ে উঠেছে। শিক্ষাবিমুখতা কতটা ঝুঁকিমুক্ত রাখতে পারবে রাষ্ট্রকে, সেই বিষয়েও কিন্তু জনমনে শঙ্কা রয়ে গেছে। অভিযোগ পাওয়া যায় যে সমাজের কোনো কোনো সেক্টরে ছাত্র পরিচিতিটা আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে মফস্বল অঞ্চলে। অনিয়ম, চাঁদাবাজি, দখলদারত্ব ইত্যাদি ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। এতে জুলাইয়ের আন্দোলনের ছাত্রদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে বৈকি। প্রশ্ন উঠেছে আজ, কেমন দেশ গড়ার কথা চিন্তা করছে সবাই, যেখানে শিক্ষিত জাতি হয়ে গড়ে উঠবার সুস্থ ও সুষ্ঠু পরিবেশ, ব্যবস্থার চেতনাটুকু দৃশ্যমান হচ্ছে না?

যদি এমন দেখা যেত যে আন্দোলনের পর ছাত্ররা সবাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে অধ্যয়নে ব্যস্ত হয়ে উঠছে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে উপযুক্ত শিক্ষা উপযোগী করে গড়ে তুলছে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই অহিংস ও ন্যায়সংগত পরামর্শ দিচ্ছে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে, যেন দেশটা আরও এগিয়ে যায়; তাদের নির্ভুলতা, সততা ও দেশপ্রেম একদিন তাদের হাতেই তুলে দেবে রাষ্ট্র পরিচালনার নেতৃত্ব। অপরাজনীতির কোনো স্থান হবে না আর এই মাটিতে। কেমন হতো তাহলে? এটা তো ঠিক যে উপযুক্ত শিক্ষা, জ্ঞান, মেধা ও অভিজ্ঞতা লাগে সঠিক নেতৃত্ব ও যেকোনো কিছু পরিচালনায়। আর রাষ্ট্র তো বিরাট বিষয়। রাষ্ট্রের সব জনগণের কেন্দ্রে যিনি পরিচালক হিসেবে অবস্থান করবেন, তাঁকে তো অভিজ্ঞ, দক্ষ ও যোগ্য হতেই হয় এবং যেটা সম্ভব হয় উপযুক্ত শিক্ষালাভে। সুতরাং শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই।

স্বপ্না রেজা, কথাসাহিত্যিক ও কলাম লেখক

নো ওয়ান কিলড তিন্নি!

ভ্যাট বৃদ্ধি ও জনজীবনে চাপ

মানুষ কী চায়

শিশুকে কোন স্কুলে ভর্তি করাবেন

বুমেরাং

অর্থ আত্মসাৎকারীদের শাস্তি হোক কঠিন

ট্রাম্প ২.০ সম্পর্কে যা ধারণা করা যায়

বাংলাদেশে বাম রাজনীতি অবস্থা-বাস্তবতা

কোথাও কোনো সুসংবাদ নেই

ভালো মা, খারাপ মা

সেকশন