হোম > মতামত > উপসম্পাদকীয়

সংস্কার ও গতিময় ইতিহাসের দেশ

অজয় দাশগুপ্ত

এই বাংলাদেশ এবং তার মুক্তিযুদ্ধ আগাগোড়াই রাজনীতির সুবর্ণ ফসল। ছবি সৌজন্য: মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ

বাংলাদেশ ইতিহাসমুখী একটি দেশ। এর কারণ বুঝতে কঠিন কিছু জানতে হয় না। বায়ান্ন থেকে একাত্তর সেই ইতিহাসের পূর্ণ অধ্যায়। এই গৌরবময় অতীত যারা অস্বীকার করে, তারা ভুলে যায় এই হচ্ছে দেশ ও জাতির মূল ভিত্তি। এর সঙ্গে কোনো শাসক, অপশাসক বা রাজনীতিকে জড়িয়ে ফেললে বড় ভুল হবে। বাংলাদেশের জন্ম রক্তগর্ভ সংগ্রামে। লাখ লাখ মানুষের জীবন ও ত্যাগের মহত্ত্বের সঙ্গে কোনো কিছুর তুলনা চলে না। এই সময়কাল থেকেই মূলত বাঙালির চাওয়া-পাওয়ার শুরু। আমাদের কৈশোর পেরোনো তারুণ্যের পরাধীনতামুক্ত এই দেশের অপমান মানে জাতি ও মানুষের অপমান। তাই এর কাছ থেকে জানতে হবে কী চাই আমরা।

কেমন বাংলাদেশ চেয়েছিলাম আমরা, সে কথা বলার আগে বলি, ‘আমরা’ বলতে এখানে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা দেখা প্রজন্মের কথা বলছি। আমাদের বালকবেলার শেষে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। পুরো তারুণ্য আর যৌবনজুড়ে আমরা যে দেশ দেখেছি, তার গায়ে অভাব আর অসচ্ছলতার চিহ্ন থাকলেও মায়া–মমতার কমতি ছিল না কোথাও। আমরা জানতাম স্বাধীনতার ব্যাপ্তি ও সীমাবদ্ধতা কতটা। স্বাধীনতা মানে কি যার যা ইচ্ছে করতে পারা? তাহলে তো উগ্রতা, সংকীর্ণতা বা দেশবিরোধিতা করাও স্বাধীনতা। মূলত স্বাধীনতা একটি জাতির সুশৃঙ্খল জীবন ও মুক্ত থাকার অধিকার। এমন একটি বাংলাদেশই চেয়েছিলাম আমরা।

রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘তোমার পতাকা যারে দাও তারে বহিবারে দাও শকতি’। এর মানে কী আসলে? সাধারণ দৃষ্টিতে মনে হতে পারে, এ আর এমন কী? একটা পতাকাই তো! সে তো একজন শিশুও বহন করতে পারে। কিন্তু এর গুরুত্ব রবীন্দ্রনাথ পরাধীন ভারতবর্ষেও টের পেয়েছিলেন। পতাকা একটি প্রতীক। প্রতীক মানচিত্রও। আসল কাহিনি থাকে বুকের ভেতর। আমাদের স্বাধীনতার কাহিনি অনেক জোরালো আর বেদনার। আমি জানি না কেন এবং কী কারণে আমরা জাতি হিসেবে বিভেদকামী। তবে এই বয়সে এসে এটুকু বুঝি, আমাদের বিভেদের কারণ রাজনীতি আর নেতৃত্ব। এই কথাগুলো এখন স্পষ্ট করে বলাও বিপজ্জনক। মধ্য পঞ্চাশে দাঁড়ানো একটি দেশ ও জাতির জন্য এটুকু জানা জরুরি যে, তার ঐক্যহীনতার শিকড় কোথায়।

মজার ব্যাপার, এই বাংলাদেশ এবং তার মুক্তিযুদ্ধ আগাগোড়াই রাজনীতির সুবর্ণ ফসল। রাজনীতিই তখন আমাদের পথ দেখাত। আজ মানুষ যাদের ভয় পায় বা যাদের কথা বিশ্বাস করে না, তারাই ছিলেন তখন মুক্তিদাতা। মানে রাজনৈতিক নেতাদের কথা বলছি। যারা তখন রাজনীতি করতেন, তারা মেপে কথা বলতেন। কাজ করতেন অধিক।

পরবর্তী সময়ে আমরা তা মানলাম না। আজকে আরেক সমস্যা। দুনিয়ার সব দেশ এখন এগোচ্ছে। আমরাও এগোচ্ছি। দেশের উন্নয়ন–অগ্রগতি যখন ধাবমান, তখন বাক্‌স্বাধীনতা ও ইতিহাস বিষয়ে কথা বলা বন্ধ হওয়ার পথে। এটা স্বাধীন কোনো জাতির জন্য ভালো হতে পারে না। অন্যদিকে বিরোধিতার চেহারাও ভয়াবহ। আমি আজকাল কোনো বিরোধিতা দেখি না, যা দেখি তার নাম অপপ্রচার আর কুৎসা। এটাও আমাদের সমাজ বিকৃতির ফসল। খেয়াল করবেন, কোনো শুভ বিষয় বা ভালো কিছু আজকাল মানুষকে টানে না। সামাজিক মিডিয়া চালু হওয়ার পর সবকিছু চলে গেছে অপপ্রচারের দখলে। যাঁরা এখন মাথার ওপর আছেন, তাঁদের দেখলে করুণা হয়। করুণা এই কারণে, একটা সময় আমাদের সমাজে যখন অবরুদ্ধ মানুষ কথা বলতে ভয় পেত বা সামাজিক জগৎ অন্ধকারে থাকত, তাঁরাই পথ দেখাতেন। এখন তাঁরা অন্ধ।

বাংলাদেশ আসলে কোন পথে যাবে বা কোনটি তার পথ—এই জিজ্ঞাসা স্বাভাবিক। তার চেয়েও জরুরি, আমাদের অন্ধকার আর পরাধীনতার চিহ্নগুলো মুছে দেওয়া।

আগামী দিনের বাংলাদেশ মূলত তারুণ্যের ওপর নির্ভরশীল। আমরা মানি বা না মানি—বিজ্ঞান, মানবিকতা আর বিশ্বাস—এই তিন বিষয় হাত ধরাধরি করে না চললে আমরা এগোতে পারব না। আমি মনে করি, আমাদের এসব বিষয় মাথায় রাখা দরকার। অভ্যন্তরীণ ঝগড়া-ফ্যাসাদ আর অনৈক্য দূরীভূত করার বিষয় এখন জরুরি। এত বছর পরও যদি সবকিছু আইন করে কানুন বানিয়ে মানাতে হয়, তাহলে সরকার পরিবর্তনের পর আবারও অন্ধকারগ্রাসী ইতিহাসের দুঃস্বপ্ন থেকেই যাবে। কে নিশ্চিত করবে নতুন কোনো জোট এসে আবার ইতিহাসের গায়ে আঁচড় কাটবে না? এবার তাহলে কী পরিমাণ ভয়াবহভাবে তা হতে পারে, সেটাই বরং দুর্ভাবনার বিষয়।

শেষ কথাটা এই, আমাদের স্বাধীনতার জন্য শুধু দেশের মানুষ লড়াই করেনি। জর্জ হ্যারিসন, রবিশংকর থেকে শুরু করে অস্ট্রেলিয়ান মুক্তিযোদ্ধা, ওডারল্যান্ডের

মতো মানুষ লড়েছিলেন। লড়েছিলেন ফ্রান্সের এক তরুণ বিমান হাইজ্যাককারী। নিজের জীবন বাজি রেখে তাঁরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বেগবান করেছিলেন। যেসব বাঙালি জান হাতে যুদ্ধ করেছিলেন, যাঁরা বীরাঙ্গনা হয়েছিলেন, তাঁদের ত্যাগ আর বীরত্ব শুধু ইতিহাসে থাকলে আমরা টবে রাখা গাছের মতো শুকিয়ে মরব। আমাদের স্বাধীনতাও ধুঁকবে। আজ বাংলাদেশের ঝলমলে উন্নয়ন আর অগ্রযাত্রার পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের সেই কথা ফের মনে রাখতে হবে—দেশ মানে ভূখণ্ড আমাদের। পতাকা আমাদের। সংগীতও আমাদের হয়েছে। এখন তা বহন করার শক্তি দরকার। মানুষই পারে তা করতে, তা করে দেখাতে। ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ আর চব্বিশের আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান ও আত্মবিশ্বাস থাকলে দেশ ও প্রবাসের বাংলাদেশিরাই পারে স্বাধীনতাকে আরও অর্থবহ ও চমৎকার করে তুলতে। এই পারাটাই হোক আমাদের সবার প্রতিজ্ঞা।

লেখক: অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী কলামিস্ট

আমাদের সংকট আসলে কোথায়

আসাদের রক্তমাখা শার্ট, বাঙালির মুক্তির নিশানা

কতিপয় গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ থেকে অর্থনীতিকে মুক্ত করতে হবে

নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কারে কমিশন কী সুপারিশ করল

‘ধর্মের কল বাতাসে নড়ে’

টানাপোড়েনের মধ্যে সংস্কার ও নির্বাচন

বার্ধক্য শুরু হয় পা দিয়ে

নো ওয়ান কিলড তিন্নি!

শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই

ভ্যাট বৃদ্ধি ও জনজীবনে চাপ

সেকশন