সম্পাদকীয়
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র নিয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্য গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৬ জানুয়ারি রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে একটি বৈঠক হয়। বৈঠকে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম, গণতন্ত্র মঞ্চ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক কমিটিসহ বিভিন্ন দলের নেতারা অংশ নেন। তবে দেশে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের অধিকাংশ বৈঠকে অনুপস্থিত ছিল। অনেকগুলো দলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি, আবার আমন্ত্রণ পেয়েও কয়েকটি দল যায়নি। বৈঠকে ঘোষণাপত্র নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জানিয়েছেন, বিষয়টি নিয়ে আরও আলোচনা হবে। কাজটি এগিয়ে নেওয়ার জন্য কমিটিও গঠন করা হতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নিয়ে এ বিষয়ে দ্রুত একটি কর্মকৌশল ঠিক করা হবে।
ঘোষণাপত্র রচনার বিষয়ে একমত হওয়া যে খুব সহজ নয়, সেটা এর মধ্যেই স্পষ্ট হয়েছে। দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির পক্ষ থেকে সালাহউদ্দিন আহমদ পাঁচ মাস পরে ঘোষণাপত্রের প্রয়োজনীয়তা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁর মতে, দলিলের রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক ও আইনি গুরুত্ব নির্ধারণ জরুরি। এটি প্রণয়নকালে সংশ্লিষ্ট সবার মতামত গ্রহণ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতি নিশ্চিত করতে হবে। ঘোষণাপত্র যেন জাতীয় ঐক্যে ফাটল সৃষ্টি না করে, সে বিষয়ে সরকারের নজর দেওয়া উচিত। অন্যদিকে জামায়াত একটি পৃথক প্রস্তাব দেওয়ার কথা বলেছে এবং তাড়াহুড়ো না করার পরামর্শ দিয়েছে। তবে তারা বিলম্বও চায় না, যা থেকে বোঝা যায়, দলটি দ্রুত কিন্তু সতর্ক পদক্ষেপে আগ্রহী। গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জানান, এটি যেন তাড়াহুড়ো করে বা যেনতেন প্রক্রিয়ায় না হয়। দলটি আইনি ও রাজনৈতিক দিক বিবেচনায় দলিল তৈরির পক্ষে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সরকারের বিলম্বের সমালোচনা করলেও উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছে। অন্যান্য দল তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেছে, যার মধ্যে কিছু বিশেষ ঘটনা (যেমন ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরের পুলিশি অভিযান) অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব এসেছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে ঐকমত্যের ভিত্তিতে ঘোষণাপত্র তৈরির কথা বলা হলেও আমাদের দেশের রাজনীতিতে ‘একমত’ হওয়ার নজির খুব কম। সে জন্যই ঘোষণাপত্র তৈরির বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান নিঃসন্দেহে একটি বড় ঘটনা। ওই অভ্যুত্থানে যে জাতীয় ঐক্য দেখা গেছে, তা অক্ষুণ্ন রাখা এবং গণতান্ত্রিক চেতনাকে সুরক্ষা দেওয়া এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ঘোষণাপত্র প্রণয়নে অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতি, সুনির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ এবং জনগণের চেতনার প্রতিফলন ঘটানো অপরিহার্য। এ প্রক্রিয়া শুধু একটি দলিল নয়, বরং জনগণের সংগ্রামের প্রতীক। এটি অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে সতর্কতার সঙ্গে প্রকাশ করা না হলে এর তাৎপর্য হারাতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকার, রাজনৈতিক দল ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সবারই উচিত জাতীয় ঐক্য রক্ষায় দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা। আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গা নড়বড়ে করা ঠিক হবে না।