হোম > বিশ্লেষণ

ইসরায়েল না থাকলে মধ্যপ্রাচ্যে ‘একটা ইসরায়েল’ বানাতে হতো যুক্তরাষ্ট্রের: বাইডেনের এ কথার অর্থ কী

জাহাঙ্গীর আলম

মধ্যপ্রাচ্যে ভয়ানক বৈরী পরিস্থিতির মধ্যে ইসরায়েলের মতো একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র কীভাবে টিকে থাকতে পারছে? এর উত্তর সম্ভবত সবারই জানা—ইসরায়েলের পেছনে আছে বৈশ্বিক সুপারপাওয়ার যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রতিবছর কোটি কোটি ডলার সামরিক সহায়তা পায় ইসরায়েল। পাশাপাশি গোয়েন্দা সহযোগিতা, জাতিসংঘে নিন্দা প্রস্তাব ঠেকিয়ে দেওয়া, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে নমনীয় হতে রাজি করানোসহ ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিতে এমন কোনো কাজ নেই, যেটি যুক্তরাষ্ট্র করে না। 

ইসরায়েল থেকে ১৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যমানের পণ্য আমদানি করে যুক্তরাষ্ট্র। আর যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলে রপ্তানি করে প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। মজার ব্যাপার হচ্ছে, উভয়েই উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হীরা আমদানি-রপ্তানি করে। এ ছাড়া ইসরায়েলে বৈদেশিক বিনিয়োগের প্রায় ৮০ বিলিয়ন ডলার আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। আর যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলের বিনিয়োগ ৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। ফলে উভয় ক্ষেত্রে ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ধরনের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। 

ওপরের পরিসংখ্যান দেখে ভাবার কোনো কারণ নেই যে ব্যবসায়িক স্বার্থেই যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের জন্য সবকিছু উজাড় করে দিতে রাজি। ইসরায়েলের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতির পেছনে প্রধান কারণটি কৌশলগত। 

১৯৮৬ সালে মার্কিন কংগ্রেসে তৎকালীন সিনেটর জো বাইডেনের দেওয়া বক্তব্যটি এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় নতুন করে শেয়ার হতে দেখা যাচ্ছে। সেই বক্তব্যে ইসরায়েল সম্পর্কে তাঁর নিজের এবং যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান বেশ পরিষ্কারভাবেই উঠে এসেছে। সেই বক্তব্যে বাইডেন স্পষ্ট করেছেন, মধ্যপ্রাচ্যে কেন ইসরায়েলকে যুক্তরাষ্ট্রের দরকার। ১৯৮৬ সালের জুনে তিনি এ বক্তব্য দেন। 

বাইডেনের বক্তব্যটি ছিল এমন, ‘সময় এসেছে, ইসরায়েলকে সমর্থন দেওয়ার জন্য আমাদের বারবার ক্ষমা প্রার্থনা করা থামাতে হবে। সেখানে ৩ বিলিয়ন ডলারের যে বিনিয়োগ, সেটিই আমাদের সেরা বিনিয়োগ। সেখানে যদি ইসরায়েল না থাকত, তাহলে ওই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষার জন্য একটি ইসরায়েল তৈরি করতে হতো!’ 

মজার ব্যাপার হচ্ছে, ১৯৮০-এর দশকে জো বাইডেন যখন মার্কিন কংগ্রেসে সিনেটর এবং সিনেটের আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটির সদস্য, তখন ওয়াশিংটনে ইসরায়েল দূতাবাস তাঁকে হিসাবেই ধরত না। ইসরায়েলের ওয়াশিংটন দূতাবাস সব সময় যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বিশেষ করে যখন ডেমোক্র্যাটরা ক্ষমতা থাকে তখন, ইসরায়েলপন্থী এবং ইসরায়েলপন্থী নয় এমন ডেমোক্র্যাট সিনেটরদের তালিকা করে। সেই তালিকায় বাইডেনের নাম ছিল না। বাইডেন কখনোই ইহুদি-ডেমোক্র্যাট রাজনীতি বা যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদি সংগঠনগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক রাখেননি। 

২০২০ সালের ডিসেম্বরে ফাঁস হওয়া গোপন নথি থেকে এসব তথ্য পাওয়া যায়। ইসরায়েলি পত্রিকা হারেৎজ এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। 

সেসব নথিতে ইসরায়েল প্রশ্নে জো বাইডেনের অবস্থানের ক্রম পরিবর্তন এবং সৌদি আরব সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি উঠে এসেছে। 

১৯৭৩ সালে ইসরায়েল সফর করেন জো বাইডেন। তখন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ার। আর বাইডেন মাত্র ৩০ বছর বয়সী সিনেটর। দাদির মতো স্নেহের সঙ্গে বুকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন বাইডেনকে। বাইডেন ওই সময় শিশুর মতো আগ্রহভরে তাঁর কাছ থেকে ‘ছয় দিনের যুদ্ধ’ এবং ইসরায়েলের বর্তমান চ্যালেঞ্জ সম্পর্কিত গল্প শুনেছিলেন। 

ইসরায়েল সরকারের গোপন নথিতে দেখা যায়, ব্যক্তিগত আলাপে ইসরায়েলের ইতিহাস নিয়ে যেভাবে বাইডেন ‘আগ্রহ ও উৎসাহ’ দেখান, তাতে তাঁকে একজন অনভিজ্ঞ সিনেটর বলেই মনে হবে। অথচ এর আগের বছরগুলোতে বরাবর ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীর এবং গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের বসতি সম্প্রসারণের বিরোধিতা করে এসেছেন তিনি। 

অবশ্য জো বাইডেনের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার মোড় ঘুরে যাওয়ার সময় ছিল সেটি। ৫০ বছরের বেশি সময়ের জাতীয় রাজনীতিতে বাইডেন ইসরায়েল ইস্যুতে ভারসাম্য রক্ষা করে চলার চেষ্টাই করেছেন। ব্যক্তিগত আলাপে তিনি ইসরায়েলি নেতাদের কড়া বার্তা দিয়েছেন, আর যখন প্রকাশ্যে বক্তব্য দিয়েছেন, তখন ইসরায়েলে পক্ষে দ্ব্যর্থহীন সমর্থনের কথাই বলেছেন। 

জো বাইডেনের পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক অবস্থান কিন্তু এখনো স্পষ্ট। ২০২১ সালে হামাস-ইসরায়েল সংঘাতে প্রধানমন্ত্রী ইসরায়েলি বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে ব্যক্তিগত সাক্ষাতে এমন কড়া বার্তাই দিয়েছেন বাইডেন। সেগুলোর খুব কমই প্রকাশ্যে এসেছে। বার্তা সংস্থা এপির প্রতিবেদনে এমন তথ্য জানানো হয়েছে। এ ছাড়া বারাক ওবামা প্রশাসন বরাবরই ইসরায়েলের বসতি সম্প্রসারণের বিরোধিতা করে এসেছে। সেই সময় ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন বাইডেন। নেতানিয়াহু সরকারের সঙ্গে সেই থেকেই তাঁর সম্পর্ক শীতল। 

১৯৮২ সালে ওয়াশিংটনে তৎকালীন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী মেনাকেম বেগিনের সঙ্গে মার্কিন আইনপ্রণেতাদের একটি গ্রুপের বৈঠক হয়। সেই গ্রুপে বাইডেনও ছিলেন। ওই বৈঠকে বাইডেন পশ্চিম তীরে বসতি সম্প্রসারণ বন্ধ করে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীকে চাপ দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। গ্রুপের অন্য সদস্যরা ইসরায়েলের অন্যান্য নীতি নিয়ে সমালোচনামুখর ছিলেন বলেও খবরে এসেছে। 

তবে এরপরই দ্রুত বাইডেনের প্রকাশ্য অবস্থান বদলাতে থাকে। সেটি স্পষ্ট হয় যখন ১৯৮৮ সালে ডেমোক্র্যাট দল থেকে বাইডেনের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হওয়ার কথা ওঠে। এর আগের বছরগুলোতে বাইডেন প্রকাশ্যে ইসরায়েলের সমর্থনে বক্তব্য দিতে থাকেন। অবশ্য ভাষণ নকল করার অভিযোগ শেষ পর্যন্ত দলীয় মনোনয়নের দৌড় থেকে সরে দাঁড়ান তিনি। 

হারেৎজে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে তৎকালীন সিনেটর জো বাইডেন এবং যুক্তরাষ্ট্রে ইসরায়েলের সাবেক রাষ্ট্রদূত মেয়ার রোসিন ও দূতাবাসের তৎকালীন কর্মকর্তা ইউসেফ লামদানের বৈঠকের কথোপকথনের কিছু অংশ উঠে এসেছে। 

ওই সময় ক্ষমতায় রিপাবলিকান পার্টির প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান। তখন রিগ্যান এবং রিপাবলিকানদের ডেমোক্র্যাটদের তুলনায় ইসরায়েলের প্রতি কম বন্ধুভাবাপন্ন মনে করা হতো। এমন সময়ে ডেমোক্র্যাট দল থেকে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হতে যাওয়া বাইডেন নিজেকে ইসরায়েলের সাচ্চা সমর্থক প্রমাণে মরিয়া চেষ্টা করেন। ওই বৈঠকের পর বাইডেন সম্পর্কে ইসরায়েলের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যায়। প্রেসিডেন্ট প্রার্থিতা পাওয়ার ক্যাম্পেইনে ইসরায়েলে সরাসরি তাদের লোক বলেই প্রচার করতে থাকে। 

বাইডেন বৈঠকে বলেন, আরবদের যুক্তরাষ্ট্রের বলে দেওয়া উচিত, ওই অঞ্চলে সবার আগে ইসরায়েলই আমাদের বন্ধু। আরবেরা যদি এতে সমস্যা মনে করে, তাহলে তাদের বোঝা দরকার, এতে আমেরিকার সঙ্গেও তাদের সমস্যা হবে। তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে অন্য মিত্রদের মতোই ইসরায়েলকে গুরুত্ব দেবেন বলেও প্রতিশ্রুতি দেন বাইডেন। এমনকি প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনকে (পিএলও) সন্ত্রাসী সংগঠন বলতেও দ্বিধা করেননি তিনি। তিনি ইসরায়েলি দূতাবাস কর্মকর্তাদের বলেন, ‘আমি নির্বাচিত হলে আপনাদের পস্তাতে হবে না!’ 

সৌদি আরব সম্পর্কে বাইডেন বলেন, ‘সৌদি আরব তো ৫০০ রাজপুত্র তাদের পরিবারের একটা জোট ছাড়া কিছুই নয়। ১৯৮২ সালে আমেরিকান নীতিতে একটা মারাত্মক ভুল হয়েছে। ওই সময় পারস্য উপসাগরে একটি কৌশলগত ঐক্য হয়। তখনই মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার প্রকৃত বন্ধু ইসরায়েলের দিক থেকে নজর চলে যায় অন্যদিকে।’ বাইডেন মূলত সৌদি আরবে মার্কিন অস্ত্র বিক্রি চুক্তির দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন। 

এই বৈঠকের চার মাস পরেই মার্কিন কংগ্রেসে দাঁড়িয়ে বাইডেন ইসরায়েলের পক্ষে জোরালো বক্তৃতা দেন। ওই বছরের জুনে মার্কিন আইনপ্রণেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ইসরায়েলকে সমর্থন দেওয়ার জন্য বারবার ক্ষমা চাওয়ার চর্চা বন্ধ করতে হবে। ইসরায়েলে যে বিনিয়োগ করা হয়েছে, সেটিই যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোৎকৃষ্ট বিনিয়োগ। আরব অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করতে হলে অবশ্যই ইসরায়েলকে দরকার। 

সেই বাইডেন অবশ্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ফিলিস্তিনে বেশ কয়েকটি সহায়তা কর্মসূচি আবার চালু করেন। এগুলো ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন বন্ধ করে গিয়েছিল। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ফেরাতে সৌদি আরব ও ইসরায়েল সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের উদ্যোগ নিয়েছেন। ইরানের সঙ্গে নতুন করে পরমাণু চুক্তি করার অঙ্গীকার করেছেন। ইরানের সঙ্গে চুক্তির এই পদক্ষেপে ইসরায়েল নাখোশ হলেও পিছপা হচ্ছেন না জো বাইডেন।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ইসরায়েল লবি কতটা শক্তিশালী, জো বাইডেনের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের এই পরিবর্তনশীল চরিত্র সেটি স্পষ্ট করে দিয়েছে।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

হাসিনা পরবর্তী বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ পাকিস্তান, সম্পর্কের রসদ ভারতবিরোধিতা

বাংলাদেশ ও পাকিস্তান নিয়ে মার্কিন ‘দুমুখো নীতি’ শোধরাবেন কি ট্রাম্প

দিনে শান্তির কথা রাতে গাজায় হামলা, ইসরায়েল কি আদৌ যুদ্ধবিরতি চায়

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের টানাপোড়েন: সংকটে রোগী আর শিক্ষার্থীরা

বুলডোজার যেভাবে মোদির ভারতের প্রতীক হয়ে উঠল

ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক কি তবে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে মোড় নেবে

আফগানিস্তানের তালেবান সরকারকে হঠাৎ কেন এত খাতির করছে ভারত

ট্রুডোর প্রতি কানাডীয়দের ভালোবাসা কীভাবে ফুরিয়ে গেল

ট্রাম্প কি সত্যিই গ্রিনল্যান্ড কিনতে চান, কিন্তু কেন

ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম থেকে ফ্যাক্ট-চেকিং সরিয়ে জাকারবার্গ কি ট্রাম্পের বশ্যতা স্বীকার করলেন

সেকশন