ভারতীয় নিউজ পোর্টাল নিউজক্লিকের সঙ্গে জড়িত বর্তমান ও সাবেক মিলিয়ে মোট ৪৬ জন সাংবাদিককে গত মঙ্গলবার জেরা করে দিল্লি পুলিশ। তাদের ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। সংবাদ আউটলেটটির ডিরেক্টর প্রবীর পুরোকায়স্থ ও এইচআর প্রধান অমিত চক্রবর্তীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।
এরপরই সাংবাদিকদের ১৮টি সংস্থা ভারতের প্রধান বিচারপতির কাছে চিঠি লিখে এর প্রতিবাদ জানিয়েছে। এর মধ্যে দিল্লির জাতীয় প্রেসক্লাব, নারী প্রেসক্লাব, কলকাতা, চণ্ডীগড়, গুয়াহাটি প্রেসক্লাব, প্রেস অ্যাসোসিয়েশন, ডিইউজেসহ ১৮টি সংগঠন আছে।
তা ছাড়া এডিটরস গিল্ড বিবৃতি দিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে। কলকাতা প্রেসক্লাবের সদস্যরা মিছিল করেও প্রতিবাদ জানিয়েছেন। দিল্লিতেও প্রেসক্লাবের সামনে প্রতিবাদ জানিয়েছেন সাংবাদিকেরা।
নিউজক্লিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ
গত আগস্টে নিউ ইয়র্ক টাইমসে একটি তদন্তমূলক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়, নিউজ পোর্টালটি চীনপন্থী প্রচারণার জন্য অর্থ পেয়েছে। মার্কিন ব্যবসায়ী নেভিল রয় সিংহমের সংস্থার কাছ থেকে এই অর্থ গেছে। চীন সরকারের যুক্তি ও বক্তব্য তুলে ধরার জন্য এই অর্থ দেওয়া হয়।
রিপোর্টে বলা হয়, এই মার্কিন ব্যবসায়ী চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেন এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চীনের প্রচারে অর্থসাহায্য করেন।
এই রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পরের দিন ১৭ আগস্ট দিল্লি পুলিশ নিউজক্লিকের বিরুদ্ধে এফআইআর করে।
পুলিশের অভিযোগ, ২০১৮ সালে নিউজক্লিক নয় কোটি ৬০ লাখ টাকার এফডিআই বা বিদেশি বিনিয়োগ অর্থ পেয়েছে। মার্কিন সংস্থা ওয়ার্ল্ডওয়াইড মিডিয়া হোল্ডিং ১১ হাজার ৫৬০ টাকা দিয়ে নিউজক্লিকের শেয়ার কিনেছে। এরপর ২০১৮ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে নিউজক্লিক ২২ কোটি টাকা বিদেশ থেকে পেয়েছে। পুলিশ সূত্র এনডিটিভি-কে জানিয়েছে, সব টাকার সূত্র ছিল নেভিল রয় সিংহম।
সিংহম ও প্রবীর পুরকায়স্থ জানিয়েছিলেন, এই অভিযোগ পুরোনো, তারা আদালতে জবাব দেবেন।
নিউজক্লিকের প্রতিক্রিয়া
নিউজক্লিক গত বুধবার একটি বিবৃতি দিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, তাদের এফআইআরের কপি দেওয়া হয়নি। তা ছাড়া কর্মীদের কাছ থেকে ইলেকট্রনিক ডিভাইস কোনোরকম সিজার লিস্ট না দিয়েই বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। নিউজক্লিক অফিস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে তারা রিপোর্টিং করতে পারছেন না।
দাবি করা হয়েছে, তারা চীনপন্থী প্রচার চালাননি।
সাংবাদিক সংস্থাগুলোর দাবি
ভারতের প্রধান বিচারপতিকে চিঠি দিয়ে ১৮টি সাংবাদিক সংগঠন জানিয়েছে, তিনি যেন সংবিধানে দেওয়া মতপ্রকাশের অধিকারকে রক্ষা করতে ব্যবস্থা নেন। কারণ, সংবিধান ও মানুষের অধিকারকে রক্ষা করার দায়িত্ব ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের হাতে রয়েছে।
দিল্লি পুলিশের স্পেশাল সেল নিউজক্লিকের সঙ্গে যুক্ত ৪৬ জন সাংবাদিক, সম্পাদক, লেখক ও পেশাদারদের বাড়িতে যায় এবং মোবাইল, ল্যাপটপ, কম্পিউটার বাজেয়াপ্ত করে। কিন্তু ডেটা সংরক্ষণের কোনো প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়নি। অথচ এটা হলো ন্যূনতম প্রোটকল।
১৮টি সংগঠনের আবেদন, সুপ্রিম কোর্ট যেন একটা নীতি তৈরি করে দেয়, যাতে এইভাবে সাংবাদিকদের ফোন, ল্যাপটপ বাজেয়াপ্ত না করা হয়। সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসাবাদের ক্ষেত্রেও একটা নীতি তৈরি করুক সর্বোচ্চ আদালত। সরকারি এজেন্সি ও কর্মীদের দায়বদ্ধতা যেন চিহ্নিত করা হয়।
সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা
সংবাদ সংস্থা রয়টার্স জানাচ্ছে, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার যে ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স তৈরি করেছে, তাতে ভারতের স্থান ১৬১তম। ভারতের এত খারাপ অবস্থান এর আগে কখনো হয়নি।
মোদী সরকার অবশ্য এই তালিকা খারিজ করে দিয়ে বলেছে, তারা যে পদ্ধতিতে তালিকা বানিয়েছে, তা মেনে নেওয়া যায় না। ভারতে স্বাধীন সংবাদমাধ্যম আছে।
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস জানিয়েছে, সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশকে খুন করা হয়েছিল। ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ৪০ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন। ১৯৮ বার সাংবাদিকেরা আক্রান্ত হয়েছেন।
আল জাজিরা জানিয়েছে, সেপ্টেম্বরে কাশ্মীর নিয়ে একটি খবরের জন্য বিবিসির বিরুদ্ধে পুলিশ প্রাথমিক আইনি ব্যবস্থা নেয়। আগস্টে কাশ্মীরওয়ালা বলে একটি ওয়েবসাইটে ব্লক করা হয়।
তবে শুধু দিল্লি নয়, পশ্চিমবঙ্গসহ বিভিন্ন রাজ্যেই সরকারের সমালোচনা করা সাংবাদিকদের নিগ্রহের অভিযোগ আছে। পশ্চিমবঙ্গে তো ভোররাতে একজন সাংবাদিকের বাড়িতে ঢুকে তাঁকে ও তাঁর স্ত্রীকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ।
কমিটি অ্যাগেইনস্ট জার্নালিস্টের রিপোর্ট তুলে ধরে দ্য ওয়্যার জানাচ্ছে, উত্তর প্রদেশে ২০১৭ থেকে ২০২২ পর্যন্ত ৪৮ জন সাংবাদিককে নিগ্রহ করা হয়েছে, ৬৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, ১২ জন মারা গেছেন।