ইয়েমেনের অচলাবস্থা দীর্ঘ দিনের। গত বছরের এপ্রিলে হুতি বিদ্রোহীদের এবং দেশটির আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকারের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়। এটি মূলত সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) মধ্যস্থতায় হয়েছে। তবে অক্টোবরেই মেয়াদ শেষ। এরপর এখনো বড় যুদ্ধ আবার শুরু হয়নি। তবে উভয় পক্ষই যুদ্ধে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে!
ইয়েমেন সংকটের শুরু যেভাবে
২০১১ সালে ইয়েমেনে নাগরিকদের অভ্যুত্থান দীর্ঘদিনের স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লাহ সালেহকে তাঁর ডেপুটি আবদরাবুহ মানসুর হাদির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য করে।
নতুন প্রেসিডেন্ট অর্থনৈতিক সমস্যা এবং জিহাদিদের আক্রমণের মতো নিরাপত্তা সমস্যা নিয়ে হিমশিম খেতে থাকেন। সেই সঙ্গে ইয়েমেনের সশস্ত্র বাহিনীর বড় অংশ ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্টের প্রতি বেশি অনুগত ছিল।
হুতিরা এই দুর্বলতার সুযোগ নেয়। আনুষ্ঠানিকভাবে ‘আনসার আল্লাহ’ নামে পরিচিত এই গোষ্ঠী ইয়েমেনের জাইদি শিয়া মুসলিম সংখ্যালঘুদের নায়কে পরিণত হয়।
২০১৪ সালের প্রথম দিকে দেশের উত্তরে সাদা প্রদেশের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর রাজধানী সানা দখল করে। ২০১৫ সালের মার্চে প্রেসিডেন্ট হাদি বিদেশে পালিয়ে যান।
ইয়েমেনের প্রতিবেশী সৌদি আরব হুতিদের অগ্রগতিতে শঙ্কিত হয়ে পড়ে। রিয়াদের ভয়, এরা চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইরানের স্যাটেলাইটে পরিণত হয় কি না।
২০১৫ সালের মার্চে সৌদি আরবসহ অন্য আরব রাষ্ট্রগুলো হুতিদের উৎখাত এবং হাদি সরকারের অবস্থান সংহত করতে যৌথ বিমান হামলা শুরু করে। তারা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স থেকেও রসদ ও গোয়েন্দা সহায়তা পায়।
সৌদি ও মার্কিন কর্মকর্তারা ইরানের বিরুদ্ধে জাতিসংঘের অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করে হুতিদের কাছে ড্রোনের মতো অস্ত্র পাচারের অভিযোগ করে। তবে ইরান এই অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করেছে।
আট বছরের নৃশংস সংঘাতে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতির ক্ষীণ আশা দেখিয়েছিল। ২০২১ সালের নভেম্বরে ইয়েমেনের উত্তর-পশ্চিমের বেশির ভাগ অংশ নিয়ন্ত্রণকারী হুতিরা বিজয়ের কাছাকাছি বলে মনে হয়েছিল। তারা মারিব শহর এবং কাছাকাছি তেল ও গ্যাসক্ষেত্রের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারলে উত্তরের যুদ্ধে জয়লাভ করত। এতে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আবেদ রাব্বো মনসুর হাদির সরকারের নিয়ন্ত্রণ বলে কিছু থাকত না।
২০২২ সালের জানুয়ারিতে আরব আমিরাতের বাহিনী হুতিদের মারিব এবং প্রতিবেশী শাবওয়াহর কৌশলগত অঞ্চল থেকে সরিয়ে দেয়। হুতিরা সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবের ভূখণ্ডে আন্তঃসীমান্ত ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা করে এর জবাব দেয়। এরপর ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী খাদ্য ও জ্বালানির সংকট তৈরি করলে সব পক্ষের ওপরই নতুন চাপ সৃষ্টি হয়।
ইউক্রেন যুদ্ধে সৃষ্ট বৈশ্বিক সংকট ইয়েমেনে অচলাবস্থা নিরসনে মধ্যস্থতার জায়গা তৈরি করেছে। গত বছরের এপ্রিলের শুরুতে জাতিসংঘ হাদি সরকার ও হুতিদের দুই মাসের যুদ্ধবিরতিতে সম্মত করে। রিয়াদও চুক্তি সমর্থন করে। হাদি পদত্যাগ করেন। প্রেসিডেন্টের নেতৃত্বাধীন আট সদস্যের কাউন্সিল (পিএলসি) দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেয়। সব পক্ষই এতে অংশীদার হয়।
তবে শান্তির আশা ম্লান হয়ে গেছে। ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে একটি সম্প্রসারিত যুদ্ধবিরতির বিষয়ে জাতিসংঘের নেতৃত্বাধীন আলোচনা অক্টোবরের শুরুতে ভেস্তে যায়। মূলত হুতি বিদ্রোহীদের বেতন-ভাতা নিয়েই গোল বাধে।
অবশ্য আনুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতি ঘোষণা ছাড়াই সব তৎপরতা প্রায় স্থগিত। আলোচনা অব্যাহত। এখন সৌদি-হুতি চ্যানেলের মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা চলছে, কিন্তু উত্তেজনা বাড়ছে। হুতিরা তেল ও গ্যাস অবকাঠামোতে নজর দিচ্ছে। তেল রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেছে। হুতি অংশীদারত্ব দাবি করছে। তা না হলে তেল বিক্রি করতে দেবে না। প্রতিশোধ হিসেবে সরকার হুতি নিয়ন্ত্রিত লোহিত সাগর বন্দর হোদেইদাহ থেকে জ্বালানি আমদানি বন্ধ করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু রিয়াদ সেটি হতে দেয়নি। উভয় পক্ষই প্রধান ফ্রন্ট লাইনের চারপাশে সামরিক সরঞ্জাম বৃদ্ধি করছে বলে জানা যাচ্ছে।
নতুন করে যুদ্ধের ঝুঁকি অস্বস্তিকরভাবে বাড়ছে। হুতি শিবিরের মধ্যে কেউ কেউ আক্রমণের কথা ভাবছে। যদিও আপাতত প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে শক্তিমত্তায় বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে তারা।
বিকল্প হিসেবে হুতিরা বেতন-ভাতার জন্য সৌদি আরবের সঙ্গে একটি চুক্তিতে যেতে পারে। যুদ্ধবিরতির সময় বাড়িয়ে শক্তিসঞ্চয় ও অর্থ সংগ্রহের দিকে নজর দিতে পারে।
এর মধ্যে কিছু হুতি নেতা রিয়াদের সঙ্গে একটি বৃহত্তর চুক্তির আশা করছেন। যুদ্ধের ময়দান থেকে সৌদির প্রস্থান এবং ইয়েমেনের প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে হুতিদের মর্যাদা নিশ্চিত হবে—এমনটাই আশা তাঁদের। তবে এ ধরনের ব্যবস্থায় হুতিবিরোধী পক্ষগুলোর স্বার্থ উপেক্ষিত হবে, যেখানে তারা এরই মধ্যে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা থেকে বাদ পড়া নিয়ে বিচলিত। এটি হলে ইয়েমেন নতুন সংঘাতে নিমজ্জিত হবে।
কারণ সৌদি বের হয়ে গেলেও আফগানিস্তানে তালেবানদের মতো হুতিরা সহজেই সমস্ত ইয়েমেন দখল করতে পারার সক্ষমতা রাখে না।
একটি বর্ধিত যুদ্ধবিরতির জন্য অন্তঃইয়েমেনি আলোচনা জরুরি। সেখানে হয়তো জাতিসংঘের মধ্যস্থতার দরকার পড়বে। কিন্তু হুতিরা যদি ইরানের ওপর তাদের আস্থা রাখে এবং তেহরানের সহায়তায় শক্তিশালী হওয়ার ভরসা করে, তাহলে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠবে। অবশ্য ইরান সম্ভবত আর সেই মেজাজে নেই!
সূত্র: ফরেন পলিসি, ক্রাইসিস গ্রুপ, বিবিসি