মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রবার্ট রস একুশ শতকে এশিয়ার রাজনীতি কেমন হবে সে প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘ভূরাজনৈতিকভাবে এশিয়া দ্বিমেরুক। যেখানে চীন তার মহাদেশীয় অবস্থানের কারণে শক্তিশালী, যুক্তরাষ্ট্র শক্তিশালী প্রশান্ত মহাসাগরে তার নৌবাহিনীর উপস্থিতির কারণে।’ এই শক্তিশালী দুই দেশের মধ্যে একটি বিতর্কিত অবস্থানে তাইওয়ান। কতটা বিতর্কিত, তা মার্কিন কংগ্রেসের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফর নিয়ে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সৃষ্ট আস্থার সংকটেই বোঝা যাচ্ছে।
অবশ্য তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এমন সংকট এই প্রথম নয়। ইতিহাসে তিনবার সংকটের মুখোমুখি হয়েছে চীন-তাইওয়ান-যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমান সংকট সেই হিসেবে চতুর্থ তাইওয়ান সংকট।
১৯৪৯ সালে মাও সে তুংয়ের নেতৃত্বে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি দেশটির ক্ষমতা দখল করলে জাতীয়তাবাদী চিয়াং কাইশেক মূল ভূখণ্ড থেকে বেরিয়ে তাইওয়ানে অবস্থান নেন। এক বছর পর ১৯৫০ সালে কোরীয় যুদ্ধের সময় তাইওয়ান যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রে পরিণত হয়। সেই সময়ই যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানকে চীনের হাত থেকে নিরাপদ রাখতে তাইওয়ান প্রণালিতে নৌবহর মোতায়েন করে। পরে ১৯৫৪-৫৫ সালের দিকে চীন দেশটির দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে তাইওয়ানের নিয়ন্ত্রণাধীন বেশ কয়েকটি ছোট ছোট দ্বীপে আক্রমণ চালিয়ে দখল করে নেয়।
প্রথম সংকটের ক্ষেত্রে, কোরীয় যুদ্ধ শেষে চীন চেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের আইজেনহাওয়ার প্রশাসন যেন তাইওয়ানের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি না করে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র চীনকে আমলে না নিয়ে ১৯৫৪ সালে তাইওয়ানের সঙ্গে চুক্তি করে। জবাবে চীন তাইওয়ানের ভূখণ্ডে হামলা করে। এই চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিত করতে চেয়েছিল যে, চীন যেন তাইওয়ান দখল না করে। কিন্তু এর বিপরীত দিকও রয়েছে। সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ইয়ান চং মার্কিন সংবাদমাধ্যম এনপিআরকে বলেন, ‘কিন্তু তারাও (চীন) আক্রমণের মাধ্যমে, চিয়াং কাইশেকও যেন চীনা ভূখণ্ডে আক্রমণ করতে না পারে (অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায়)—সেই বিষয়টি নিশ্চিত করতে চেয়েছে।’
১৯৫৮ সালে তাইওয়ান-চীন দ্বিতীয় দফা সংকটে পতিত হয়। ওই বছর চীন মাসব্যাপী আক্রমণের সূচনা করে। চীনের মূল ভূখণ্ডের খুবই নিকটবর্তী তাইওয়ানের দুটি দ্বীপ কিনমেন ও মাৎসু ছিল ওই আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তায় তাইওয়ানও চীনা আক্রমণের জবাব দেয়। মাসব্যাপী এই যুদ্ধে চীন কোনো ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণে নিতে পারেনি।
দ্বিতীয় সংকটের ক্ষেত্রে, সংকট নিরসনে যুক্তরাষ্ট্র চীনের বিরুদ্ধে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের পরিকল্পনা করেছিল। তবে প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার সেই পরিকল্পনা নাকচ করে দেন। ১৯৫৮ সালে চীন ঘোষণা দেয়, তাইওয়ানের আশপাশে মার্কিন উপস্থিতি না থাকলে তারা মাসের জোড় তারিখগুলোতে হামলা চালাবে না। এই অদ্ভুত ঘোষণার পর চীন-তাইওয়ান উভয় পক্ষই এক প্রচারযুদ্ধ জারি রাখে। এই অবস্থা চলে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত। সে সময় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন ফস্টার ডুলেস চীনের ওই ঘোষণাকে প্রচারণা কৌশল হিসেবে ঘোষণা করে বলেন, ‘তাদের এই প্রচারণার উদ্দেশ্য ছিল মনস্তাত্ত্বিক এবং এর নকশা করা হয়েছিল এই অভিব্যক্তি সৃষ্টি করতে যে—তারাই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণকর্তা।’
১৯৯৫ সালে তাইওয়ানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট লি তেং-হুই যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে এক পুনর্মিলনীতে যোগ দেন। এই সফর বেইজিং-তাইপে-ওয়াশিংটন সম্পর্ক আরও জটিল করে তোলে। এই সফরই তৃতীয় চীন-তাইওয়ান সংকট উসকে দেয়। ১৯৯৬ সালে তাইওয়ানে প্রথম সরাসরি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লি তেং-হুই বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। সব মিলিয়ে উত্তপ্ত চীন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে তাইওয়ানের মূল ভূখণ্ডের নিকটবর্তী জলসীমায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করে। জবাবে প্রতিশ্রুতি অনুসারে তাইওয়ান প্রণালিতে যুদ্ধবিমান মোতায়েন করে যুক্তরাষ্ট্র। তবে অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই বিষয়টি মিটে যায়।
কোনো একটি সংকট কীভাবে শুরু হয়, সে বিষয়ে নানা ধরনের পূর্বানুমান থাকে। তবে কোনো সংকটই নজিরবিহীনভাবে শুরু হতে পারে না। তেমনি পেলোসির তাইওয়ান সফরকে কেন্দ্র করে চতুর্থ তাইওয়ান সংকট শুরু হওয়ার যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে। তবে অতীতের তিনটি সংকটই যখন খুব বড় কোনো সংঘাতে রূপ নেওয়ার আগেই থেমে গেছে, এবারও আশা করা যেতে পারে, কোনো ধরনের সংকট শুরুর আগেই তা মিটে যাবে।
এই বিষয়ে ইয়ান চং বলেন, ‘আগের সংকটগুলোর মতো এবারও একই পক্ষ জড়িত থাকলেও এবারের বিষয়টি আলাদা।’ ফলে একেবারেই নতুন এবং ভিন্ন পরিস্থিতিতে উদ্ভূত বর্তমান চীন-তাইওয়ান সংকটও নতুন সমাধান আশা করে।
তবে চীনের সেই পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণে। এ বিষয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিষয়ক ব্যুরোর ডেপুটি-অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি সুসান শির্ক এনপিআরকে বলেন, ‘উভয় পক্ষই যেভাবে সামরিক সংঘাতের মুখোমুখি হয়েও শান্ত আচরণ করেছিল, তা অবাক করা মতো। এর পর থেকে উভয় দেশই চেষ্টা করেছে, নিজেদের মধ্যে একটি সম্পর্কের পাটাতন গড়ে তুলতে, যাতে ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে না হয়।’
সুসান শির্ক আরও বলেন, যদি সেই সময় চীন আক্রমণ করা থেকে বিরত না থাকত, তবে পরিস্থিত নিঃসন্দেহে ভয়াবহ হতো। তবে পরিস্থিতি আর কোনোভাবেই আগের মতো নেই। বর্তমানে চীন আর্থিক এবং সামরিক সক্ষমতায় যুক্তরাষ্ট্রকে অতিক্রম করে না গেলেও যুক্তরাষ্ট্রের ঘাড়ে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার নিশ্বাস ফেলছে। ফলে এখন যদি এই দুই দেশের মধ্যে কোনো ধরনের উত্তেজনা তৈরি হয়, তবে তা অবশ্যই ১৯৯৬ সালের চেয়ে গভীর উৎকণ্ঠার জন্ম দেবে।
পেলোসির সফর নিয়ে চীন যদি প্রতিবাদ না করে বিষয়টি গড়িয়ে যেতে দেয়, তবে আপাতদৃষ্টিতে দেশটিকে দুর্বল মনে হতে পারে। মনে হতে পারে, দেশটি ভারসাম্য রক্ষার সক্ষমতা অনেকটাই হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু এসব বিষয়ের চেয়েও অর্থনৈতিক সংকটের দ্বারপ্রান্তে থাকা চীনের জন্য বর্তমানে স্থিতিশীলতাই বেশি প্রয়োজন।
এ নিয়ে অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ওয়েন-তি সাং এনপিআরকে বলেন, ‘চীন যদি পেলোসিকে নিরাপদে তাইওয়ান থেকে চলে যেতে দেয়, তবে চীনকে হয়তো দুর্বল মনে হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তবে এই সময়ে চীনের জন্য স্থিতিশীলতা সত্যিই প্রয়োজন। এ কারণেই চীনের যুদ্ধে জড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। কারণ, যুদ্ধই দেশটির স্থিতিশীলতার সবচেয়ে বড় ঝুঁকি।’
তথ্যসূত্র: ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি জার্নাল, দ্য ডিপ্লোম্যাট, এনপিআর, এএফপি