হোম > বিশ্লেষণ

টেল অব থ্রি ন্যাশনস: যেভাবে ঋণ সংকট কাটিয়ে উঠছে শ্রীলঙ্কা, ঘানা ও জাম্বিয়া

অনলাইন ডেস্ক

বৈশ্বিক ঋণ সংকট বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। উন্নয়নশীল দেশগুলোর তো বটেই বিভিন্ন উন্নত দেশ, এমনকি আন্তর্জাতিক কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠানও এই সংকটে খাবি খাচ্ছে। জাতিসংঘের উন্নয়ন সংস্থার (ইউএনডিপি) হিসাব বলছে, বিশ্বের অন্তত ৫৪টি দেশ ঋণ সংকটে ভুগছে। এসব দেশের মধ্যে ঘানা, শ্রীলঙ্কা ও জাম্বিয়া অন্যতম। সম্প্রতি দেশগুলোর গাড্ডায় পড়া অর্থনীতি দারুণভাবে ফিরে আসতে শুরু করেছে। 

তিন দেশের মধ্যে প্রথম বিপদে পড়ে জাম্বিয়া। দেশটি ২০২০ সালের জুন মাসে প্রথমবারের মতো ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়। ঘানা নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে এবং শ্রীলঙ্কা কয়েক মাস আগে, ২০২২ সালের জুন মাসে। 

দেশগুলোর ঋণ সংকটের সাধারণ কিছু চরিত্র রয়েছে। বিশেষ করে, অব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে। এ কারণে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর অর্থনৈতিক কাঠামো মারাত্মকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছিল। এ ছাড়া অন্যান্য কারণের মধ্যে অপর্যাপ্ত কর আয়, মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার ফাঁদ ও চীনের দেওয়া দ্বিপক্ষীয় ঋণ পরিশোধের চ্যালেঞ্জ অন্যতম। 

তবে প্রতিটি দেশের নিজস্ব কিছু সমস্যা ছিল। যেমন, শ্রীলঙ্কা বিপুল পরিমাণ মুদ্রা ছাপানোর পাশাপাশি কৃষি খাতের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত করে এমন নীতি গ্রহণ করেছিল। ঘানা অবাস্তবিক নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে গিয়ে অর্থনীতির বারোটা বাজিয়েছিল এবং জাম্বিয়া নির্দিষ্ট কিছু খাতে কর্মসংস্থা বৃদ্ধি ও জলবায়ুর নাজুক প্রভাব মোকাবিলা করতে গিয়ে দেউলিয়া হয়েছিল। 

নীতিগত ত্রুটি ও অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা শ্রীলঙ্কায় বহুমুখী বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়। অসময়ে কর কমানো, জৈব কৃষি গ্রহণের দ্রুত প্রচেষ্টা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমার সময়ও ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ না হওয়ার রেকর্ড বজায় রাখার প্রচেষ্টা, বিনিময় হারের বিলম্বিত সমন্বয় এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয় আসন্ন এমন সতর্কবার্তা পাওয়ার পরও তা আমলে না নেওয়া দেশটির অর্থনীতিকে দেউলিয়া হওয়ার পথে নিয়ে যায়। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার কমে যাওয়ায় বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থাও কমে যায়। যা সংকটকে আরও ঘনীভূত করে। 

তহবিলের অপব্যবহার, কর কমানো, বিপুল ভর্তুকি দিয়ে অবাস্তব নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন ঘানার অর্থনৈতিক পতনকে ত্বরান্বিত করে। দেশটি যেসব খাতে কর সংস্কার বা কর হ্রাস করেছে সেসব খাতের মধ্যে রয়েছে—আবাসন, আর্থিক পরিষেবা, আমদানি শুল্কের ওপর ভ্যাট কমানো, স্বাস্থ্য সেবারও ওপর থেকে কর বিলুপ্তি, জাতীয় বিদ্যুতায়ন প্রকল্পের শুল্ক হ্রাস, জন বিদ্যুতায়ন খাতে শুল্ক কমানো এবং বিশেষ পেট্রোলিয়াম পণ্যের করের ওপর কর হ্রাস। 

জাম্বিয়ার পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন হলেও দেশটির আর্থিক ভারসাম্যহীনতা অতিরিক্ত ঋণের চাপ তৈরি করে। জাম্বিয়া নির্দিষ্ট কিছু খাতে কর্মসংস্থান সংশ্লিষ্ট খাতে নতুন করে ভাতা পুনঃস্থাপন, জলবায়ু দুর্বলতার কারণে অর্থনৈতিক ধাক্কা ইত্যাদি কারণে দেশটির অর্থনীতিতে ক্রমবর্ধমান চাপ সৃষ্টি করেছে। 

সংকটের কারণ ভিন্ন হলেও তিনটি দেশই একই পরিণতি বরণ করেছে। দেশগুলোর বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের বিষয়টি কঠিন হয়ে গিয়েছিল। এমনকি রাষ্ট্রীয় ব্যয় নির্বাহ ও আমদানির জন্য বেসরকারি খাতের ঋণের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। ফলে দেশগুলোর অর্থনৈতিক সংকট ও ঋণ পরিস্থিতি আরও ঘনীভূত হয়েছে এবং দেশগুলোকে দেউলিয়ার পথে যেতে বাধ্য করেছে। 
 
ঋণ সংকট শুরুর পর দেশটি তিনটি সর্বশেষ উপায় হিসেবে দাতা সংস্থা আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দ্বারস্থ হয়। জবাবে আইএমএফও আগ্রহ দেখায় সংকট কাটিয়ে ওঠার সহযাত্রী হতে। তবে অবশ্যই শর্তসাপেক্ষে। এ ক্ষেত্রে আইএমএফ মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে শ্রীলঙ্কা ও ঘানার ক্ষেত্রে এক রকম কৌশল ও নিম্ন আয়ের দেশ হিসেবে জাম্বিয়ার সঙ্গে অন্যরকম কৌশল গ্রহণ করে। যেমন ঘানা ও শ্রীলঙ্কাকে শর্ত দেওয়া হয় আইএমএফের ঋণ পেতে হলে অবশ্যই অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে গৃহীত ঋণগুলোকে পুনর্গঠন করতে হবে। বিপরীতে জাম্বিয়াকে এমন বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। 

শর্ত মানার পর আইএমএফ ঘানা ও শ্রীলঙ্কাকে ৩০০ কোটি ডলার করে এবং জাম্বিয়াকে ১৩০ কোটি ডলার ঋণ সুবিধা দেয়। এই তিনটি দেশের মধ্যে জাম্বিয়া সবচেয়ে বেশি সুবিধা পেয়েছে। কারণ দেশটি বিশ্ব ব্যাংক ও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের উচ্চ ঋণ সংবলিত দরিদ্র দেশের (এইচআইপিসি) তালিকাভুক্ত। কোনো দেশ এইচআইপিসি-ভুক্ত হওয়ার অর্থ হলো—এই দেশগুলো সুবিধাজনক শর্তে দাতা দেশগুলোর সঙ্গে পুরোনো ঋণ নবায়ন করতে পারে। 
 
জাম্বিয়াকে দেওয়া এই সুবিধা বৈশ্বিক ঋণ সংকটের মধ্যে ‘মধ্যম আয়ের’ ফাঁদের বিষয়টিকে আরও তীব্র করে তুলেছে। এই বিষয়টি থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, মধ্যম আয়ের যে দেশগুলো ঋণ সংকটে আবদ্ধ তাদের জন্য আরও অনেক সহজ শর্তে ঋণ ও সংকট মোকাবিলায় প্রচলিত কৌশলের বাইরে গিয়ে অধিকতর উন্নত কৌশল অবলম্বন প্রয়োজন। 
 
বৈশ্বিক ঋণ সংকটে চীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই ধারাবাহিকতা দেখা গেছে ঘানা, শ্রীলঙ্কা ও জাম্বিয়ার ঋণ সংকটের ক্ষেত্রেও। কারণ জাম্বিয়ার বৈদেশিক ঋণের ১৭ দশমিক ৬ শতাংশই চীনের। ঘানার বৈদেশিক ঋণের মাত্র ৩ শতাংশ চীনের। ঘানায় চীনের বিনিয়োগ মূলত দেশটির কোকোয়া, বক্সাইট ও জ্বালানি তেল খাতে। এই দুই দেশে চীনের পরিমাণ সামান্য হলেও শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণের প্রায় অর্ধেকই চীনের। দেশটির মোট ঋণের ৪৫ শতাংশই চীনের। আর চীন এককভাবে শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে ঋণ দাতা হওয়ায় আইএমএফের সঙ্গে ঋণ চুক্তি নিয়ে বেশ সমস্যা দেখা দিয়েছিল। 
 
চীনের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ প্রকল্প হলো—বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ। এই প্রকল্পের মাধ্যমে দেশটি বিভিন্ন দেশকে বিপুল পরিমাণ ঋণ দিয়েছে। এই ঋণ চীন সরকারের রাজস্ব আয়ের অন্যতম উৎস। তাই দেশটি ঋণ পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে অনেক বেশি সতর্ক। কারণ এ ক্ষেত্রে অনেক দেশ ঋণ খেলাপি হয়ে উঠতে পারে। যা দেশটির চাপে পড়া অর্থনীতিতে আরও চাপে ফেলতে পারে। এসব কারণে চীন ঋণ পুনর্গঠনের ব্যাপারে খুবই সতর্ক। 

জাম্বিয়ার ক্ষেত্রে চীন খুব সতর্ক অবস্থান নিয়েছে। যেমন, দেশটিকে দেওয়া চীনের এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংকের ৪০০ কোটি ডলার ঋণের সুদহার কমাতে সম্মত হয়েছে আইএমএফের শর্ত মেনে। নতুন নির্ধারিত সুদহার হলো মাত্র ১ শতাংশ। এই ঋণ পরিশোধের সময়সীমা হলো ২০৩৭ সাল। 

আবার শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণ ঋণ থাকার পরও চীন দেশটিকে আরও ৪২০ কোটি ডলার ঋণ দিতে যাচ্ছে। গত অক্টোবরের মাঝামাঝি শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহের চীন সফরের সময় বিষয়টি নির্ধারিত হয়। এটি আইএমএফের ঋণ প্রাপ্তির শর্ত সহজ করবে। কারণ চীনা ঋণের সহায়তায় শ্রীলঙ্কা অভ্যন্তরীণ ঋণ পরিশোধে সক্ষম হবে। এরই মধ্যে দেশটির অর্থমন্ত্রী শেহান সেমাসিংহে বলেছেন, ঋণের বিষয়টি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আইএমএফের সঙ্গে কর্মকর্তা লেভেলে আলোচনা চূড়ান্ত হয়েছে। 

চীন শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ঋণ পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে যে মনোভাব দেখিয়েছে তা ঘানাকে আশার আলো দেখাতেই পারে। দেশটি আশা করছে চীন আইএমএফের শর্ত পূরণে তাদের সহায়তা করবে। যা হোক, চীনের সঙ্গে ঋণ পুনর্গঠন করতে গিয়ে যেসব প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছে তা থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলো তা থেকে শিক্ষা নিতে পারে। 

দ্য ডিপ্লোম্যাট থেকে অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান

হাসিনা পরবর্তী বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ পাকিস্তান, সম্পর্কের রসদ ভারতবিরোধিতা

বাংলাদেশ ও পাকিস্তান নিয়ে মার্কিন ‘দুমুখো নীতি’ শোধরাবেন কি ট্রাম্প

দিনে শান্তির কথা রাতে গাজায় হামলা, ইসরায়েল কি আদৌ যুদ্ধবিরতি চায়

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের টানাপোড়েন: সংকটে রোগী আর শিক্ষার্থীরা

বুলডোজার যেভাবে মোদির ভারতের প্রতীক হয়ে উঠল

ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক কি তবে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কে মোড় নেবে

আফগানিস্তানের তালেবান সরকারকে হঠাৎ কেন এত খাতির করছে ভারত

ট্রুডোর প্রতি কানাডীয়দের ভালোবাসা কীভাবে ফুরিয়ে গেল

ট্রাম্প কি সত্যিই গ্রিনল্যান্ড কিনতে চান, কিন্তু কেন

ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম থেকে ফ্যাক্ট-চেকিং সরিয়ে জাকারবার্গ কি ট্রাম্পের বশ্যতা স্বীকার করলেন

সেকশন