কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ার বাসিন্দা এইচএসসি পরীক্ষার্থী ইলিনা আক্তার ইভা সৌদিপ্রবাসী বাবার মৃত্যুসংবাদ পায় তার পরীক্ষার আগের দিন। সে জানতে পারে, তার বাবার লাশ মরুভূমিতে ময়লার ভাগাড়ের পাশে পড়ে ছিল। হাত বিচ্ছিন্ন, চোখ ওপড়ানো, নাড়িভুঁড়ি বাইরে বের হওয়া ক্ষতবিক্ষত লাশের ছবি দেখে পরদিন পরীক্ষার হলে যায় ইভা।
গত শনিবার পরীক্ষা শেষ হয় ইভার। হল থেকে বের হয়ে ইভা বলে, ‘৫০ দিন হতে চলল নির্মম মৃত্যুর শিকার বাবার লাশ পায়নি তাঁর পরিবার। তার মৃত্যু কীভাবে হয়েছে, তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য জানাতে পারেনি ওয়েজ আর্নার্স বোর্ড বা সৌদিতে বাংলাদেশি দূতাবাস। আবেদন করার ৪৫ দিন পেরিয়ে গেলেও দেশে ইভার বাবার লাশ দেশে আনা সম্ভব হয়নি। ইভার এখন একটাই আকুতি, সে অন্তত একবার তার বাবার লাশটি দেখতে চায়।
ইভার পরিবার সূত্রে জানা গেছে, গত ১৪ আগস্ট ইভার বাবা কাজী সালাউদ্দিন হিমনের (৪৮) ক্ষতবিক্ষত লাশ সৌদির নাজরানের ইয়াদামা শহরের মরুভূমিতে দেখে সহকর্মীদের একজন তাঁর বড় মেয়ে ইলিনা আক্তার ইভাকে জানান। ছবি দেখে নিহতের মেয়ে ও পরিবারের সদস্যরা নিশ্চিত হন এটি কাজী সালাহউদ্দিন হিমনের লাশ।
কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার ষাইটশালা গ্রামের মৃত কাজী নাছির উদ্দিনের ছেলে কাজী সালাহউদ্দিন হিমন ২০১৯ সালের নভেম্বরে ভাগ্য বদলের আশায় সৌদি আরবের বিখ্যাত কোম্পানি ব্রাঞ্চ ইসসাম অ্যান্ড কোম্পানিতে কাজে যোগ দেন।
নিহতের সহকর্মীরা পরিবারের সদস্যদের জানান, ঘটনার দিন দুপুরে বিরতির সময় খাবার খেয়ে আর কাজে ফেরেননি কাজী সালাহ উদ্দিন। পরে সন্ধ্যা হয়ে গেলে অনেক খোঁজাখুঁজি করে লাশ মরুভূমির ময়লার ভাগাড়ের পাশে পড়ে থাকতে দেখা যায়।
নিহতের স্ত্রী ইয়াসমিন বেগম ঘটনার দুই দিন পর ১৬ আগস্ট লাশ দেশে আনার জন্য প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স বোর্ড বরাবর আবেদন করেন। কিন্তু আবেদনপত্র জমা দেওয়ার ৪৫ দিন পার হলেও লাশ দেশে ফেরত আসেনি। এমনকি লাশ কোথায় আছে, কীভাবে মৃত্যু হয়েছে এসবে কিছুই জানাতে পারেনি ওয়েজ আর্নার্স বোর্ড।
পরিবারের পক্ষ থেকে দফায় দফায় সৌদিতে বাংলাদেশ দূতাবাসে যোগাযোগ করা হলে মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশি তদন্ত চলছে—এর বেশি কিছু জানাতে পারেনি।
সৌদিতে বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তা এমদাদুল হকের সঙ্গে কথা হয় পরিবারের। তখন তিনি তাঁদের বলেন, ‘মৃত্যুর ঘটনা পুলিশ তদন্ত করছে। আমরা আমাদের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি যাতে দ্রুত তদন্ত শেষ হয়।’ পরে আবার যোগাযোগ করা হলে এমদাদুল হক বলেন, তিনি এখন আর সৌদি আরবে নেই। ইসলাম মোহাম্মদ নামের একজন এখন তাঁর দায়িত্বে আছেন।
নিহতের বড় মেয়ে ইলিনা আক্তার ইভা বলে, ‘বাবার ক্ষতবিক্ষত লাশের ছবি দেখে পরীক্ষার হলে ঢুকি। পরীক্ষায় ঠিকমতো লিখতে পারিনি। বারবার বাবার বীভৎস ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। আমার বাবার সঙ্গে কী এমন ঘটেছিল যে তাঁকে এমন নির্মমতার শিকার হতে হলো। আমি এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত চাই। দ্রুত লাশ দেশে ফেরত আনার ক্ষেত্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’
পুত্রশোকে কাতর নাজমুন নাহার এ প্রতিবেদককে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন। শেষ বয়সে ছেলে কাজী সালাউদ্দিন হিমনের লাশ না দেখে মরতে চান না তিনি। তাই ছেলের লাশ দেশে ফিরিয়ে আনতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাহায্য চেয়েছেন তিনি।
নিহতের স্ত্রী ইয়াসমিন বেগম বলেন, ‘ঘটনার একদিন আগে ইলিনার বাবা ফোন করে বলেন, সামনে মেয়ের পরীক্ষা। পরীক্ষা শেষে তাকে ভালো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করে দেবে। কিন্তু পরদিন তার মৃত্যুর খবরে সবকিছু এলোমেলো হয় গেছে। কি কারণে আমরা স্বামীকে নির্মমতার শিকার হতে হল এর সুষ্ঠু তদন্ত চাই এবং আমার স্বামীর লাশ যেন দ্রুত দেশে আনা হয় সে ব্যবস্থা নিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’