আগ্রাবাদে খোলা নালার এক স্থানে গত চার দিনে মোট সাতজন পড়েছে বলে দাবি করেছেন স্থানীয়রা। এর মধ্যে সোমবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী সাদিয়া নিহতের পর অরক্ষিত নালার বিষয়টি সামনে আসে।
মঙ্গলবার সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, যে জায়গায় পা পিছলে সাদিয়া পড়েছে, সেখানে রাস্তার পাশে কোনো ফুটপাত নেই। নালার ওপর এক ফুটের সরু একটি পিলার। এ পিলারের ওপরই প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ পার হতো।
পাশেই পান সিগারেটের দোকান করেন পরিমল বড়ুয়া। তিনি বলেন, গত চার দিনে দুই নারীসহ সাতজন এ নালায় পড়েছে। গত শুক্রবার এক মহিলা পড়ে গিয়ে চিৎকার করছিল। আমিসহ আশপাশের দোকানিরা গিয়ে তাঁকে উদ্ধার করেছি। মোগলটুলির বাসিন্দা ওই মহিলা এখনো অসুস্থ। এরপর শনিবার তিন পথচারী, সোমবার সকালে একজন ও রাতে সাদিয়া একই জায়গায় পড়েছে।'
পাশের দোকানি কিশোর মল্লিক বলেন, এখানে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ চলায় সড়কের বেহাল দশা। ফুটপাত ছোট হয়ে গেছে। আর ওই জায়গা খোলা থাকায় প্রায় সময় মানুষ পড়ে যায়। আমরা গিয়ে উদ্ধার করি। দিনের বেলা সরু ওই পিলারে কোনোরকম পার হওয়া গেলেও, রাতের বেলা কোনো বাতি নেই। ঘুটঘুটে অন্ধকার, সবাই নালায় পড়ে যাচ্ছে। অন্তত একটি রেলিং থাকলেও মানুষ বাঁচত।'
সোমবার সাদিয়া যে দোকান থেকে চশমা কিনতে গিয়েছিলেন সে দোকানি আবছার বলেন, `উন্নয়নকাজ চলছে, কিন্তু এত বেহাল দশা আমার জীবনে দেখিনি। সড়কে হাজার খানিক গর্ত, ধুলোবালি, অরক্ষিত নালা নর্দমায় মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। প্রশাসন কি করছে? আমার বুঝে আসে না।
নগরীতে খোলা নালায় পড়ে এ বছর মোট চারজন প্রাণ হারান। গত ২৫ আগস্ট ভারী বৃষ্টিতে মুরাদপুর এলাকায় খালে পড়ে তলিয়ে যান সালেহ আহমদ নামের এক সবজি ব্যবসায়ী। যার হদিস এখনো মেলেনি। চলতি বছরের ৩০ জুনও ষোলোশহর চশমা হিল এলাকায় খালের পাশের সড়ক দিয়ে যাওয়ার সময় খালে পড়ে যায় একটি অটোরিকশা। স্রোত থাকায় খালে তলিয়ে মারা যান চালক সুলতান (৩৫) ও যাত্রী খাদিজা বেগম (৬৫)।
এ ছাড়া ২০১৮ সালের ৯ জুন আমিন জুট মিল এলাকায় স্রোতে ভেসে যায় শিশু আল আমীন (৭)। ২০১৭ সালের ২ জুলাই এম এম আলী সড়কে রয়েল গার্ডেন কমিউনিটি সেন্টার সংলগ্ন বড় নালায় পড়ে তলিয়ে যান সাবেক সরকারি কর্মকর্তা শীলব্রত বড়ুয়া (৬২)।
কিন্তু এসব মৃত্যুর দায় নিতে রাজি নন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) এবং চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। এরা এক সংস্থা অন্য সংস্থার ওপর দায় চাপাতে ব্যস্ত। মঙ্গলবার ঘটনাস্থল সরেজমিন পরিদর্শন করে মেয়র এম রেজাউল করিম বলেন, এভাবে প্রাণহানি দুঃখজনক। এখানে সিডিএ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ করছে। তারা ফুটপাত কেটে দেড় ফুট করে ফেলেছে। দেড় ফুট জায়গা দিয়ে হাঁটতে গেলেতো দিনের বেলায়ও মানুষ পড়ে যাবে। রাতের বেলার কথা বাদ দিলাম। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে সেখানে একটি লোহার নেট ছিল সেটিও তারা তুলে ফেলেছে। অন্তত নেটটা থাকলেও এই দুর্ঘটনা ঘটত না। কোনো রেলিং দেয়নি। এখানে তাদের অন্তত বেড়া দেওয়া উচিত ছিল। অবহেলা ছাড়া আর কি!
চসিকের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল আলম আজকের পত্রিকাকে বলেন, `সিডিএ নগরীর সব নালা খালে জলাবদ্ধতা প্রকল্পের কাজ করছে। প্রায় ১৫১ কিলোমিটার খাল নালা আছে নগরীতে। এ ছাড়া এলিভেটেডের কাজের জন্য দেওয়ানহাট থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত ফুটপাত, নালাও তাদের দায়িত্বে। আমরা এখানে এখন কোনো কাজই করতে পারি না, এসব তাদের দায়িত্ব।'
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে জলাবদ্ধতা প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক লে. কর্ণেল শাহ আলী বলেন, `আমি সিটি করপোরেশনের অভিযোগের পাল্টা জবাব দিতে রাজি নই। তবে যেসব জায়গায় নালায় মানুষ পড়ছে, সেসব জায়গায় আমরা এখন কাজ করছি না। আগ্রাবাদ নালায় মানুষ পড়লে, সেটা আমাদের দায় না। সেখানে আমাদের কোনো কাজ হচ্ছে না। তা ছাড়া বৃষ্টি হলেই নগরীতে সড়ক, খাল, নালা সব একাকার হয়ে যায়।'
নগর পরিকল্পনাবিদ আশিক ইমরান বলেন, নগরীতে ব্যস্ত জায়গায় ফুটপাত নেই, এটা অকল্পনীয়। সব দেশেই নগরীতে আগে পথচারীদের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখা হয়। এখানে দুই সংস্থার অবহেলায় নগরবাসী প্রাণ হারাবে এটা মেনে নেওয়া যায় না। এসব প্রাণহানি অপরিকল্পিত কাজের কারণে হচ্ছে। এভাবে তারা দায় এড়াতে পারে না।