ভক্তদের দীর্ঘ প্রতীক্ষা শেষে প্রকাশিত হলো বেজবাবাখ্যাত সুমনের নতুন গান ‘বয়স হলো আমার’। নানা রোগের সঙ্গে লড়াই শেষে দীর্ঘদিন পর ২৪ সেপ্টেম্বর নিজের গান প্রকাশ করলেন তিনি। সুমনের সঙ্গে কথোপকথনে ছিলেন মীর রাকিব হাসান।
‘বয়স হলো আমার’ গানে কী আছে?
এটা খুবই সাদামাটাভাবে গাওয়া। গানটিতে কোনো বেইজ সোলো নেই, কোনো ভয়ংকর লিড নেই, ড্রামসের কোনো ক্যারিকেচার নেই! মহানের খুব সুন্দর বাজানো অ্যাকুয়াস্টিক গিটারের ওপর সাদামাটাভাবে আমার গাওয়া লিরিকনির্ভর গান এটি। এটি আমার ধীরে ধীরে বয়স বেড়ে যাওয়ার গান, এটি আমার গত দুই বছর প্রায় পঙ্গু হয়ে বিছানায় পড়ে থাকার গান, এটি আমার অন্ধকারে ডুবে যাওয়ার গান, এটি আমার রাতের পর রাত প্রচণ্ড ব্যথায় চিৎকার করার গান, এটি আমার সব বাধা অতিক্রম করে আলোয় ফিরে আসার গান।
জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার এক অদম্য শক্তি আপনার মাঝে। কোথায় পেয়েছেন এই শক্তি?
সম্ভবত ব্যাপারটা জেনেটিক। আমার বাবা মানসিকভাবে প্রচণ্ড শক্ত একজন মানুষ । তাঁর কাছ থেকে ব্যাপারটা পেয়েছি বোধ হয়। বাবাকে দেখলে একটা অন্যরকম শক্তি পাই।
অবশ্যই ভেঙে পড়েছি। কিন্তু কাউকে বুঝতে দেইনি।
প্রথম যখন ক্যানসার ধরা পড়ল, আপনার মনে হলো পুরো বাংলাদেশ ঘোরা উচিত। দেশের যত জেলায় গাড়িতে যাওয়া যায় সব জায়গায় ঘুরেছেন। আমেরিকায় ৩১ দিনে ২৮টি প্রদেশ ঘুরেছেন সাড়ে ১৪ হাজার মাইল গাড়ি চালিয়ে….
অন্যদিকে ব্যস্ত থাকা অথবা যে কাজটা করলে মন ভালো থাকে সেটা করাই বেঁচে থাকার অন্যতম ‘টনিক’।
কনসার্টে গাওয়ার জন্যও কি প্রস্তুত আছেন?
পুরো একটা কনসার্ট করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত, তবে শারীরিকভাবে নই। আরও দুই-তিন মাস লাগবে। টানা তিন বছর গিটার বাজানো বা গান গাওয়া হয়নি। তাই অনুশীলনের প্রয়োজন আছে।
আপনার জীবনে এক একটা ঝড় বয়ে গেছে। ঝড়ের মুখোমুখি হওয়া, ঝড় থেকে উত্তরণ। সেই সময়গুলো নিয়ে যদি কিছু বলতেন। আমি কিছু উল্লেখ করতে পারি…
২০০১ সালের কথা। কনসার্টে গান গাইছিলেন। হঠাৎ মনে হলো আর চোয়াল বন্ধ করতে পারছেন না! ডাক্তার বলেছিলেন, এই চোয়াল নিয়ে আর কখনো গান গাওয়া যাবে না! সেখান থেকে জয়ী হয়েছেন আপনি।
আমার চোয়ালের একটা রোগ হয়েছিল তখন। এটাকে ‘টিএমজি ডিসঅর্ডার’ বলে। আমার কেইসটা ছিল সিভিয়ার। বেশি বড়ভাবে মুখ হা করলে চোয়ালের এক সাইড ডিসলোকেটেড হয়ে যেত! সে সময় ডাক্তার আমাকে একটা ‘ডেঞ্চার’ দিয়েছিল মুখে পরে থাকার জন্য। সেটা মুখে পরে থাকলে ঠিকমতো কথা বলা জেত না। আই মিন কথা বললে সবাই বুঝতে পারত যে আমি মুখে কোনো একটা ইমপ্ল্যান্ট পরে আছি। তিন মাস পর পর সিঙ্গাপুরে গিয়ে ইনেজকশন দিয়ে আসতে হতো। কিন্তু আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না যে আমি আর গান গাইতে পারব না। তবে ডাক্তারের কথায় দমে যাইনি। ব্যাপারটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিলাম। যখনই গান গাওয়ার চেষ্টা করতাম, শুনলে মনে হতো আমি মুখে বড় সাইজের দুইটা সুপারি নিয়ে গান গাইছি। প্রথম দিকে অসহায় লাগত। কিন্তু অসম্ভব রকম প্র্যাকটিস করতে করতে নিজেই একটা টেকনিক বের করলাম। ৯ মাস পর অর্থহীনের ‘ধ্রুবক’ অ্যালবাম রিলিজ দিলাম। প্রতিটা গান গাওয়ার সময় মুখে ‘ডেঞ্চার’ লাগানো ছিল। এখনো পর্যন্ত কেউ সেই অ্যালবামের গান শুনে বুঝতে পারে না যে আমি মুখে ব্রেইস লাগিয়ে গানগুলো গেয়েছিলাম। তারপর আরও বেশ কয়েক মাস মুখে সেই ইমপ্ল্যান্ট লাগিয়েই কনসার্ট করেছি। কেউ বোঝেনি। তারপর আবার সিঙ্গাপুরে গিয়ে ডাক্তার দেখানোর পর সে বলল আমার আর ডেঞ্চার পরে থাকার দরকার নেই, চোয়াল ঠিক হয়ে গেছে। ব্যাপারটা আমার জন্য একটা মিরাকল ছিল।
হ্যাঁ। অনেক মোটা ছিলাম। ৫৮ সাইজের প্যান্ট পরতাম। চলতে-ফিরতে অনেক কষ্ট হতো। মিউজিক সিনে অনেক সুমন আছে। সে সময় সবাই আমাকে ‘মোটা সুমন’ হিসেবেই চিনত। ২০০৪ সালের ডিসেম্বরের ৪ তারিখ একটা পার্টিতে আমি সিরিয়াসলি ডিসিশন নিই ওজন কমানোর। আমি তখন কোক খাচ্ছিলাম। আমার পাশে তখন সম্ভবত আর্টসেলের সাজু দাঁড়ানো ছিল। আমি তাকে বললাম, এটাই আমার লাস্ট কোক, আর খাব না, আজকে থেকে আমি শুকানো শুরু করব। সেই সময় থেকে আমি দিনে অসম্ভব রকমের কম খাওয়া শুরু করি। শুধু চা, টোস্ট বিস্কুট, নিউট্রিশন আর ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট খেয়ে চলতাম। দিনে পাঁচ ঘণ্টা খেলতাম আর এক্সারসাইজ করতাম। ১৮ মাসে কমিয়েছিলাম ৯২ কেজি। অনেকের ধারণা, আমি সার্জারি করে ওজন কমিয়েছি। ধারণাটা সম্পূর্ণ ভুল। আর্টসেল, ক্রিপটিক ফেইট, আরবোভাইরাস, নেমেসিসের মতো অনেকগুলো ব্যান্ডের মেম্বার এর সাক্ষী। আমার শুকানোর পুরো সময়টায় তারা আমার পাশে ছিল। তারা দেখেছে আমি কতটা কষ্ট করে শুকিয়েছি।
যতটুকু জানি, মেরুদণ্ডে মোট ৭টি স্ক্রু নিয়ে ঘোরেন। পাকস্থলীর ক্যানসারের সার্জারিতে পুরো পাকস্থলীই কেটে ফেলা হয়েছে। এখন এসব সমস্যা কোন স্টেজে আছে?
এখন আমি সম্পূর্ণ ক্যানসারমুক্ত। মেরুদণ্ডের দুটি সার্জারি করাতে হবে বছরখানেকের মধ্যে। আশা করি কোভিডের অবস্থা একটু ভালোর দিকে গেলে জার্মানিতে গিয়ে সার্জারি করাব।
দীর্ঘদিন ধরে আপনি চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন। যতটুকু জানি, আপনার সচ্ছলতা রয়েছে। তার পরও কোনো সমস্যার সম্মুখীন কি হতে হয়?
আল্লাহ্র রহমতে হতে হয়নি।
এত ক্যানসার, এত সমস্যার পরও হাসিখুশি থাকেন কীভাবে?
হ্যাপিনেস ইজ আ চয়েজ অ্যান্ড লাইফ ইজ বিউটিফুল
আমার মনে হয় আমার জীবনটা অনেক ইন্টারেস্টিং। আমি অনেক ধরনের মানুষের সাথে মিশেছি এই জীবনে। তাঁদের জীবনেও অনেক ইন্টারেস্টিং গল্প আমি শুনেছি। আমি বেশির ভাগ গান লেখার সময় ‘সত্য’ কথা লিখতে পছন্দ করি। আমি যা অনুভব করতে পারি, সেটা আমি অনেক সহজে লিখতে পারি। তাই আমার জীবন অথবা আমার আশপাশের মানুষের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো নিয়েই রূপক ধারায় আমি খুব সাধারণভাবে গান লিখি। এ কারণেই হয়তো গানগুলো গল্পের মতো হয়ে যায়।
বেজ গিটারের প্রতি আপনার এই ভালো লাগাটা তৈরি হলো কীভাবে?
আয়রন মেইডেনের একটা লাইভ কনসার্টের ভিডিওতে স্টিভ হ্যারিসের বেজ প্লেয়িং দেখে প্রথম মাথায় আসে বেজ বাজাব। তারপর আমাদের স্কুলে রক স্ট্র্যাটার একটা কনসার্টে ওয়ারফেইজের কমল ভাই গেস্ট মেম্বার হিসেবে বেজ বাজাতে আসেন। সেদিন কমল ভাইয়ের বেজ বাজানো দেখার পর আর পেছনে ফিরে তাকাইনি।