প্রশ্ন: আফগানিস্তানের বিপক্ষে মিরপুর টেস্ট জেতার পর ড্রেসিংরুমে বিশেষ বক্তব্য দিতে দেখা গেল। বক্তব্যে বিষয়বস্তু কী ছিল?
মুমিনুল হক: পেসারদের ধন্যবাদ দিয়েছিলাম। কারণ, আমাদের পেসাররা এমন বোলিং করে, ওদের এখন নেটেও খেলতে অসুবিধা হয়। বলছিলাম, এই যে ভালো ব্যাটিং করেছি, তাতে তোমাদের অবদান বেশি। তোমরা যত ভালো বোলিং করবে, নেটে তোমাদের খেলতে সমস্যা হবে। ম্যাচে আমাদের কাজও তত সহজ হবে। নেটে এখন তাসকিন-ইবাদত-শরীফুলকে কাট, ফ্লিক করার বল পাই না। মারতে গেলে জোর করে মারতে হয়। কথায় আছে, যে দলের বোলিং যত ভালো, তাদের ব্যাটিং তত ভালো। বিশ্বাস করুন, এখন ম্যাচের চেয়ে আমাদের নেটে চাপ থাকে বেশি! নেটে যখন ব্যাটিং করি, একটু অমনোযোগী থাকলে গায়ে লেগে যাবে। এটা আমাদের জন্য ভালো, এতে আরও ব্যাটিং উন্নতি হবে।
প্রশ্ন: আপনার অধিনায়কত্বের পর্বে একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ পেস বোলিংয়ে বড় একটা পরিবর্তন। এটার শুরুটা কখন, কীভাবে?
মুমিনুল: এটার পরীক্ষামূলক শুরু যখন জাতীয় লিগে চট্টগ্রামের অধিনায়কত্ব করি। তখন তিন পেসার খেলাতাম। জাতীয় লিগে যখন ভালো ফল এল, ভেবেছিলাম, সুযোগ পেলে জাতীয় দলেও করব। আপনারাও (সংবাদমাধ্যম) আমাদের ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছেন। বারবার প্রশ্ন এসেছে, কেন একজন পেসার খেলে বাংলাদেশে। পেসারদের সারা দিন আপনি নেটে বোলিং করান, শিখবে না, যতক্ষণ না তাদের ম্যাচে সুযোগ দিচ্ছেন। ভারতের ইশান্ত শর্মার বড় উন্নতিই হয়েছে ৬০টা টেস্ট খেলার পর। ইবাদত হোসেনের কথাই যদি বলেন, শুরুর দিকে ১৪০ (ঘণ্টায় কিমি) করত, কিন্তু কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। কিন্তু আমরা মনে করতাম, সে যদি ধারাবাহিক জায়গায় করতে পারে, দলকে অনেক কিছু দেবে।
প্রশ্ন: আপনার অধিনায়কত্বে মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্ট জেতার পর ছন্দটা পরে সেভাবে আর ধরে রাখা যায়নি। সেটার কারণ কী?
মুমিনুল: পরের সফর দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে প্রত্যাশা বেড়ে গিয়েছিল। নিউজিল্যান্ডকে হারানোর পর মনে হয়েছিল, দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়েও ওদের হারাতে পারব। তখন বলেছিলাম, আমাদের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে পরের টেস্টগুলো। ওই (নিউজিল্যান্ডে) টেস্ট না জিতলে ওরা হয়তো সেভাবে রেট করত না, যেটা দক্ষিণ আফ্রিকা আমাদের করেছিল। তখন বোলাররা যেভাবে উন্নতি করেছিল, তখন বোলার সংখ্যায় ঘাটতি ছিল।
প্রশ্ন: টেস্টে আপনার ১২টা সেঞ্চুরি, আরও বেশি হতে পারত কি না?
মুমিনুল: আমি যে ৫৭টা টেস্ট খেলেছি, অন্তত আরও ৫টা বেশি অর্থাৎ ১৬-১৭টা থাকলে ভালো হতো। বিশেষ করে যেগুলো দেশে খেলেছি, আরও পাঁচ-ছয়টা হলে ভালো হতো।
প্রশ্ন: প্রাসঙ্গিকভাবে পুরোনো প্রশ্ন আবার করা, দেশে ১১ সেঞ্চুরির বিপরীতে বিদেশে ১ সেঞ্চুরি। এখানে স্কিলের চেয়ে কি মনস্তাত্ত্বিক কোনো বাধা কাজ করে?
মুমিনুল: দুই-তিন বছর আগে মেন্টাল ব্যারিয়ার ছিল। শ্রীলঙ্কায় সেঞ্চুরি, নিউজিল্যান্ডে ৮৮ করার পর এখন মনে হয়, না, বাইরেও (সেঞ্চুরি) হবে।
প্রশ্ন: ১০ বছরের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে কঠিন সময় কি গত বছরের অধিনায়কত্ব ছাড়ার সময়টা?
মুমিনুল: গত বছর যা গেল—খুবই যন্ত্রণাদায়ক। আমার বাবা-মা পর্যন্ত হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। সমাজে বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে তাঁদের মিশতে হয়। আশপাশের মানুষের কথা শুনে অনেক হতাশ হয়ে পড়েন। তখন ভাই-বোন অনেক সমর্থন জুগিয়েছে। তারা আমাকে বুঝতে দিত না যে আমি কী কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। সবচেয়ে বেশি সাপোর্ট দিয়েছে আমার স্ত্রী। আর খেলার মানুষের মধ্যে স্যার। কোচ সালাউদ্দিন। ছোটবেলা থেকে তিনি আমার মানসিকতা জানেন। নির্বাচক সুমন ভাইও (হাবিবুল বাশার) অনেক সাপোর্ট দিয়েছেন।
প্রশ্ন: অধিনায়কত্বের চাপ সহ্য করতে না পারার আসলে কারণ কী?
মুমিনুল: ঠিক জানি না। আমার কাছে মনে হয় বেশির ভাগ চাপ এসেছে মিডিয়া থেকে। অধিনায়ক হিসেবে শেষের দিকে যখন পারফর্ম করতে পারছিলাম না, অনেকেই চাইছিল না আমি আর অধিনায়কত্ব করি। ওই চাপটা হয়তো আমার ওপর চলে এসেছিল। তবে হ্যাঁ, তখন দল যদি ভালো ফল করত, হয়তো এতটা চাপ তৈরি হতো না।
মুমিনুল: নেতা দুই ধরনের—কেউ ঝাড়ি দিয়ে কাজ আদায় করে। বাংলাদেশে এ ধরনের নেতারাই বেশি সফল, সক্রিয়। কিছু নেতা থাকে, যারা ভালোবাসা দিয়ে কাজ বের করতে চায়। বাংলাদেশে এ ধরনের নেতা চলেই না। আমি দ্বিতীয়টি, আমারটা চলেনি।
প্রশ্ন: একাদশ নির্বাচন কিংবা টসের সিদ্ধান্তে আপনার ওপর সিনিয়রদের প্রভাব নিয়ে যে গুঞ্জন শোনা গেছে, সেটার ব্যাখ্যা কী?
মুমিনুল: না, এটা একেবারেই ঠিক না। টসের সিদ্ধান্ত আমার আর কোচের। সিনিয়রদের ফাঁসাতে এটা অনেকে বলতে পারে। তবে সিনিয়রদের পরামর্শ, অভিজ্ঞতা শুনতাম। সেটা নেওয়া না-নেওয়া আমার ব্যাপার। তাঁরা কখনো বলেননি এটা কর, ওটা কর। বেশির ভাগ সময়ে তাঁরা সমর্থনই দিয়েছেন।
প্রশ্ন: অধিনায়কত্ব ছাড়তে কি খারাপ লাগছিল, যেহেতু টেস্ট দলটা নতুনভাবে গড়ে উঠছিল।
মুমিনুল: না, খারাপ লাগছিল না। ওই পরিস্থিতি ছাড়াটাই সেরা অপশন ছিল। চেয়েছিলাম, অধিনায়কত্বের সময়ে দলে কিছু একটা উন্নতি করা। এখন যখন পেসাররা ভালো করে, অনেক ভালো লাগে। দলের অনেকে আমাকে এটার জন্য কৃতিত্বও দেয়।
প্রশ্ন: আপনার চোখে বাংলাদেশের কোচ হিসেবে দুই হাথুরুসিংহের (২০১৭ ও ২০২৩) মধ্যে পার্থক্য কী?
মুমিনুল: পার্থক্য বলতে, আগের চেয়ে হাথুরুকে এখন অনেক শান্ত মনে হয়। সে আমাকে অনেক রেট করে। টেস্টে আমাকে অনেক মূল্য দেন।
প্রশ্ন: তাহলে এবার হাথুরুকে আগের মতো কড়া হেডমাস্টার মনে হচ্ছে না?
মুমিনুল: তখন দলের বেশির ভাগ ক্রিকেটার পরিণত ছিল না, বেশির ভাগের প্রসেস সম্পর্কে বেশি ধারণা ছিল না। তখন আমরা শিখেছি। তিনি চলে যাওয়ার পর আমরা সেটা ধরে রেখেছি। এবার এসে দেখলেন, যেখানে রেখে গিয়েছিলেন, সেখান থেকে আরও বেটার হয়েছে। এখন তার প্লেয়ার ম্যানেজমেন্ট আরও ভালো হয়েছে। দেখেছেন খেলোয়াড়েরা অনেক পরিণত হয়েছে। ড্রেসিংরুমের কালচারে পরিবর্তন হয়েছে। আর এখন দলের একজন তরুণ ক্রিকেটার অনেক স্মার্ট।
প্রশ্ন: টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের পরের চক্রে বাংলাদেশের ভিশন কী হওয়া উচিত?
মুমিনুল: দেশের মাঠে সবকটি (৬) টেস্ট জেতা উচিত, সে প্রতিপক্ষ যে-ই হোক। তাহলে পয়েন্টে এগিয়ে যাওয়া যাবে, টেবিলে আরেকটু ওপরে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হবে। বিদেশে তো কন্ডিশন আমাদের পক্ষে থাকে না।