বাগেরহাটে প্রকাশ্যে এসেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) অভ্যন্তরীণ কোন্দল। কমিটি গঠন ও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব দিন দিন দৃশ্যমান হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ কোন্দলে সরকারবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রাম থেকে ছিটকে পড়ছে দলটি। সাংগঠনিক দিক দিয়েও দুর্বল হয়ে পড়েছে দেশের অন্যতম বড় এই রাজনৈতিক দল।
জেলা পর্যায়ের রাজনৈতিক সভা-সমাবেশে নিজেদের মধ্যে মারামারির ঘটনা পর্যন্ত ঘটেছে। এসব কারণে অনেক নেতা-কর্মী স্বেচ্ছায় দল ত্যাগ করেছেন। এই অবস্থায় দলের স্বার্থে অভ্যন্তরীণ কোন্দল মিটিয়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার দাবি জানিয়েছেন তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা।
বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এক দশক ধরে দায়িত্বে থাকা বাগেরহাট জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি এম এ সালামকে ২০১৯ সালের ২১ ডিসেম্বর অব্যাহতি দেওয়া হয়। দীর্ঘদিন রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় থাকা এ টি এম আকরাম হোসেন তালিমকে জেলা বিএনপির আহ্বায়ক করা হলে দলের মধ্যে স্পষ্ট দুটি গ্রুপ তৈরি হয়।
কেন্দ্র ঘোষিত নতুন আহ্বায়ক কমিটিকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে এম এ সালাম ও তাঁর অনুসারীরা বিক্ষোভ করেন। এর পর থেকেই বিভিন্ন দলীয় কর্মসূচিতে দুই গ্রুপের নেতা-কর্মীরা আলাদা সভা-সমাবেশ করা শুরু করেন।
এদিকে দায়িত্ব নেওয়ার দুই বছরের বেশি সময়ে জেলার ৯টি উপজেলা ও ৩টি পৌরসভার কোনো ইউনিটের পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে না পারা বর্তমান আহ্বায়ক কমিটির অযোগ্যতা হিসেবে দেখছেন তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা।
সবশেষ ২০২১ সালের ১৩ নভেম্বর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সভায় বিএনপির বিদ্রোহী গ্রুপের হামলার ঘটনা ঘটে। সাবেক সভাপতি এম এ সালামের নির্দেশে এই হামলা হয় বলে অভিযোগ করেছিলেন জেলা বিএনপির আহ্বায়ক এ টি এম আকরাম হোসেন তালিম। অবশ্য সেসময় তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন এম এ সালাম। জেলার নেতাদের এমন কর্মকাণ্ডে হতাশ হয়ে পড়েন দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা নেতা-কর্মীরা। ক্রমান্বয়ে দুর্বল হতে থাকে জেলা বিএনপির সাংগঠনিক কার্যক্রম।
শুধু মূল দল নয়, বিএনপির সহযোগী সংগঠন যুবদল, ছাত্রদল, শ্রমিক দল, স্বেচ্ছাসেবক দল ও মহিলা দলের কমিটি নিয়েও দুই গ্রুপের মধ্যে প্রকাশ্যে কোন্দল রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাগেরহাট সদর উপজেলার একটি ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি বলেন, কয়েক বছর আগেও বাগেরহাট ছিল বিএনপির ঘাঁটি। কিন্তু জেলার নেতাদের কোন্দলে সাংগঠনিকভাবেই তাঁরা দুর্বল হয়ে গেছেন। দল প্রায় কর্মীশূন্য হয়ে পড়েছে। অতি দ্রুত জেলা পর্যায়ের সমস্যা সমাধান করে প্রান্তিক পর্যন্ত দলকে একত্রিত করতে না পারলে সামনের নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি হবে বলে মনে করেন এই নেতা।
সদর উপজেলার ডেমা ইউনিয়ন বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শেখ আফজাল হোসেন বলেন, এম এ সালামের নেতৃত্বে প্রায় এক যুগ তাঁরা ঐক্যবদ্ধ ছিলেন। যেকোনো আন্দোলনে হাজার হাজার নেতা-কর্মী রাজপথে থাকত। কিন্তু আহ্বায়ক কমিটি হওয়ার পরে দল স্পষ্ট দুটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, বর্তমান জেলা বিএনপির আহ্বায়ক এ টি এম আকরাম হোসেন তালিম ১৯৯৬ সালের পর থেকে দলীয় কার্যক্রমের বাইরে ছিলেন। দলীয় কোনো নেতা-কর্মীর বিপদে (মামলা-হামলা) তিনি পাশে ছিলেন না। হঠাৎ ‘উড়ে এসে জুড়ে বসার’ মতো দলের দায়িত্ব নিয়েছেন। এই বিষয়টি তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা মানতে পারেননি। ফলে দলীয় শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে।
ষাটগম্বুজ ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মোস্তাইন বিল্লাহ বলেন, ‘জিয়াউর রহমানের হাতে তৈরি এই দলে বিভেদ কখনোই চাই না। এত বছর আমরা ক্ষমতার বাইরে। তারপরেও সিনিয়র নেতৃবৃন্দ পকেট কমিটি করে, এক পক্ষ আরেক পক্ষের নামে অভিযোগ করে। তৃণমূল নেতা-কর্মীদের কথা শোনার সময় তাঁদের নেই। এভাবে কি আর দল চলে?’
২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনের পর থেকে দলীয় কর্মকাণ্ডে নিষ্ক্রিয় থাকা জেলা শ্রমিক দলের সাবেক সভাপতি সরদার লিয়াকত আলী বলেন, এক সময় আন্দোলনে প্রকম্পিত থাকত বাগেরহাটের রাজপথ। অথচ এখন নেতা-কর্মীরা ঘর থেকেই বের হওয়ার সাহস পান না। এই দায় অবশ্যই দায়িত্বে থাকা নেতাদের নিতে হবে। দলকে বাঁচাতে হলে, সবাইকে বিভেদ ভুলে যোগ্য নেতার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান তিনি।
বাগেরহাট জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি এম এ সালাম বলেন, বর্তমান আহ্বায়ক দীর্ঘদিন বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না। তাই সাধারণ নেতা-কর্মীরা তাঁর ডাকে সাড়া দিচ্ছেন না। অনেক তরুণ ও ত্যাগী নেতা-কর্মীরা তাঁকে চেনেও না। ফলে দুই বছরের বেশি সময়েও তিনি জেলার কোনো ইউনিটের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করতে পারেননি। দলের স্বার্থে স্বল্প সময়ের মধ্যে যোগ্য নেতা দিয়ে পূর্ণাঙ্গ জেলা কমিটি গঠনের দাবি জানান তিনি।
তিনি বলেন, ‘দলের দুঃসময়ে নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা-মামলায় আমি পাশে ছিলাম, এখনো আছি, আগামীতেও থাকব। বাগেরহাট জেলার সকল আন্দোলন সংগ্রামে আমার সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে।’
জেলা বিএনপির আহ্বায়ক এ টি এম আকরাম হোসেন তালিম বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বিএনপির জেলা কমিটি কুক্ষিগত করে রাখা হয়েছিল। পরে তারেক জিয়ার নির্দেশেই ত্যাগীদের নিয়ে আহ্বায়ক কমিটির অনুমোদন দেওয়া হয়। এই কমিটি বাগেরহাটে দলকে সাংগঠনিকভাবে আগের চেয়ে আরও শক্তিশালী করেছে। তবে ক্ষমতাসীন দল ও প্রশাসনের ‘মিথ্যা’ মামলা ও হামলার কারণে দলীয় কার্যক্রম কিছুটা স্তিমিত বলে দাবি করেন তিনি।