সাফ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ-নেপাল ফাইনাল খেলার সময় (১৯ সেপ্টেম্বর বিকেলে) দেশে কোনো লোডশেডিং ছিল না। এ তথ্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি)। আর গণমাধ্যমের খবর হচ্ছে, বিদ্যুৎ না থাকায় বাংলাদেশ দলের কৃতী খেলোয়াড়দের অন্যতম কৃষ্ণা রানীর মা খেলা দেখতে পারেননি।
এর কোনটি ঠিক? কৃষ্ণা রানীর মা যে বিদ্যুৎ না থাকায় খেলা দেখতে পারেননি, সেটা মিথ্যা হওয়ার কথা নয়। কেননা, তিনি যে গ্রামে থাকেন, সেখানে আরও অনেক মানুষ লোডশেডিংয়ের শিকার এবং সাক্ষী। তাঁদের প্রতিনিধি হিসেবে কৃষ্ণার মাকে গণমাধ্যম শিরোনাম করেছে।
তাহলে কি পিডিবির তথ্য অসত্য? সাধারণভাবে তা-ই মনে হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা না-ও হতে পারে। কীভাবে? কয়েক বছর ধরে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বিআরইবি) গ্রামাঞ্চলের বিদ্যুৎ বিতরণব্যবস্থায় এত বেশি নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সামগ্রী ব্যবহার করে আসছে, যেগুলো গ্রামাঞ্চলে স্বাভাবিক বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত করছে। তাই লোডশেডিং না থাকলেও ওই সব সামগ্রীর কারণে গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
প্রসঙ্গত, চাহিদার তুলনায় বিদ্যুতের উৎপাদন কম থাকলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সময়-সময় বিভিন্ন এলাকায় যে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখে, সেটা হচ্ছে লোডশেডিং। কিন্তু দেশে এখন চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ উৎপাদন কম নয়। তাই গ্রামাঞ্চলের অনেক এলাকা যে প্রায়ই বিদ্যুৎবিহীন থাকে, তার কারণ লোডশেডিং নয়। বিদ্যুৎ সরবরাহ বা বিতরণব্যবস্থার সমস্যা, যা মূলত সৃষ্টি করছে নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সামগ্রী।
গ্রামাঞ্চলে অনেক কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হতে দেখা যায়। যেমন ঝড়-বাদলে বিদ্যুৎ লাইনের ওপর গাছ কিংবা ডালপালা ভেঙে পড়া, লাইনের ওপর পাখি বসা, বিদ্যুতের খুঁটি উপড়ে কিংবা ভেঙে পড়া, বজ্রপাত, ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণ প্রভৃতি। বিতরণব্যবস্থায় মানসম্পন্ন বৈদ্যুতিক সামগ্রী ব্যবহার করা হলে এর অনেকগুলোই রোধ করা যায়।
সেই লক্ষ্যে প্রায় তিন বছর আগে, ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে সরকার তথা বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় নতুন ধরনের (স্পেসিফিকেশন) উন্নতমানের কিছু বৈদ্যুতিক সামগ্রীর তালিকা করে বিতরণ কোম্পানিগুলোকে সেগুলো কেনার নির্দেশ দেয়। এসব সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে ফিউজ কাট-আউট, লাইটনিং অ্যারেস্টার, ফিউজ লিংক, লাইন হার্ডওয়্যার, সাবস্টেশন কানেক্টর, স্টলি ক্রসআর্ম প্রভৃতি। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিআরইবি ওই স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী কোনো বৈদ্যুতিক সামগ্রী কিনতে পারেনি। পুরোনো দিনের নিম্নমানের সামগ্রীই ব্যবহার করা হচ্ছে।
বিআরইবি সূত্রে জানা যায়, তারা নতুন স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী কিছু সামগ্রী কেনার জন্য একটি দরপত্র আহ্বান করেছিল। স্থানীয় কয়েকটি কোম্পানি তাতে অংশ নিয়েছিল। এর মধ্যে একটি কোম্পানিকে দরপত্রের শর্ত লঙ্ঘন করে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। কোম্পানিটি ছিল অযোগ্য। বিআরইবির কোনো ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কিংবা অন্য কোনো প্রভাবশালীর ইঙ্গিতে কোম্পানিটিকে কাজ দেওয়া হলেও তারা সময়মতো মালামাল সরবরাহ করতে ব্যর্থ হয়। কিন্তু বিধান থাকা সত্ত্বেও রহস্যজনক কারণে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে বিআরইবি কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।
বিআরইবি ৮০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মাধ্যমে দেশের গ্রামাঞ্চলে নিরবচ্ছিন্ন ও নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহের লক্ষ্যে অনেক সুনামের সঙ্গে কাজ করে এসেছে। দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়নের ক্ষেত্রেও এই প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা ছিল প্রধান। কিন্তু কয়েক বছর ধরে পল্লী বিদ্যুতের বিতরণব্যবস্থায় ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন বৈদ্যুতিক সামগ্রী, কংক্রিটের খুঁটি (এসপিসি পোল) প্রভৃতি কেনার ক্ষেত্রে যথেষ্ট অনিয়ম ও দুর্নীতির খবর পাওয়া যাচ্ছে।
বিআরইবি গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ বিতরণব্যবস্থার সম্প্রসারণ, আধুনিকায়ন ও সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ এসপিসি পোল কিনে থাকে। এই খুঁটি কেনায় অনেক আগের কালের দুর্নীতি আবার ফিরে এসেছে এবং জেঁকে বসেছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। মাঝখানে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গ্রহণযোগ্য দামে মানসম্পন্ন এসপিসি পোল সরবরাহ করছিল। খুঁটি কেনায় দুর্নীতিও দূরীভূত হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে এমন কিছু প্রতিষ্ঠান খুঁটি সরবরাহের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছে, যাদের খুঁটির মান গ্রহণযোগ্য নয়।
বিআরইবি সূত্র জানায়, এসব প্রতিষ্ঠান নতুন গজিয়ে ওঠা। এসপিসি পোল তৈরি ও সরবরাহের কাজে এরা অনভিজ্ঞ। এদের তৈরি এসপিসি পোলে রড ব্যবহার করা হয় কম। ব্যবহৃত কংক্রিটের মান দরপত্রের চাহিদা পূরণ করে না। লাইনে ব্যবহার করার অল্প কিছুদিনের মধ্যে এগুলো বাঁকা হয়ে যায়। ব্যবহারের উপযোগী থাকে না। তারপরও এসব প্রতিষ্ঠানের খুঁটি দেদার কেনা হচ্ছে। ফলে প্রতিবছর বিপুল অর্থের অপচয় হচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহও বিঘ্নিত হচ্ছে।
সূত্র জানায়, যেসব প্রকল্পে এসপিসি পোলসহ বিতরণসামগ্রী কেনায় বিশ্বব্যাংক, এডিবি প্রভৃতি উন্নয়ন সংস্থার সহযোগিতা থাকে, সেখানে এসব গজিয়ে ওঠা প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করতে পারে না। কেননা, সেই সব প্রকল্পে ওই সব উন্নয়ন সংস্থার নির্দেশিত ও অনুমোদিত দরপত্র দলিল অনুযায়ী আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে মালামাল সরবরাহ নিশ্চিত করতে হয়। এ ব্যাপারে সংস্থাগুলোর কড়া নজরদারি থাকে। তাই দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি উন্নয়ন সংস্থাগুলোর নির্দেশাবলি অনুসরণ করতে বাধ্য থাকে। ফলে দরপত্রের স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী মানসম্পন্ন সামগ্রী পাওয়া যায়।
কিন্তু সমস্যা হয়, জিওবি ফান্ডের (সরকারি অর্থায়নের) প্রকল্পে যেখানে শুধু স্থানীয় দরপত্রের মাধ্যমে দেশীয় মুদ্রায় মালামাল কেনা হয়। এ ক্ষেত্রে অনেক সময় দরপত্রের শর্ত সংযোজন-বিয়োজন করে, দরপত্রে উল্লিখিত স্পেসিফিকেশন যথাযথভাবে অনুসরণ না করেই পছন্দের কোনো প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। ফলে গ্রামাঞ্চলের বিদ্যুৎ বিতরণব্যবস্থায় একের পর এক যুক্ত হতে থোকে নিম্নমানের সামগ্রী। গ্রামাঞ্চলে বাড়তে থাকে বিদ্যুৎ-বিভ্রাট। বিদ্যুৎহীনতা।
অভিযোগ আছে, বিআরইবির সাবেক ও বর্তমান কোনো কোনো শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তার নিকটাত্মীয়-স্বজন নিম্নমানের বিতরণসামগ্রী সরবরাহের সঙ্গে যুক্ত। তাঁরা এসব সামগ্রী তৈরির কারখানাও স্থাপন করে নিয়েছেন। তাঁদের কাছ থেকে সামগ্রী কেনার আগে সেসব কারখানা পরিদর্শনের বিধান থাকলেও তা করা হয় না। করলেও সেই কারখানার প্রকৃত মান ও সক্ষমতা বিবেচনা না করেই কার্যাদেশ দেওয়া হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দরপত্রের শর্ত লঙ্ঘন করেও দেওয়া হয়। এসপিসি পোল ছাড়াও বিতরণ ট্রান্সফরমার কেনার ক্ষেত্রেও এমন ঘটনার নজির রয়েছে।
সরকার বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দিয়ে চাহিদার তুলনায় বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা গড়ে তুলেছে। কিন্তু গ্রামাঞ্চলের মানুষ সেই বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। তাদের মধ্যে ধারণা জন্মেছে যে সরকার আসলে সবাইকে বিদ্যুৎ দিতে অসমর্থ। এই ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টি হচ্ছে পল্লী বিদ্যুতের মতো একটি প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-দুর্নীতির ফলে। এতে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। সেই ভাবমূর্তি রক্ষায় সরকারকেই উদ্যোগী হতে হবে।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক