২৫ জুন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর সড়কপথ যানবাহনের জন্য খুলে দেওয়া হবে। কয়েক দিন আগে এই সেতুর সড়কপথ ব্যবহারকারী যানবাহনগুলোর টোলের হার ঘোষণা করা হয়েছে। আমার বিবেচনায় টোলের এই হার অযৌক্তিকভাবে বেশি নির্ধারণ করা হয়েছে। পদ্মা সেতু এ দেশের জনগণের অর্থে নির্মিত জাতির গর্বের ধন। ২০১৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি যখন তদানীন্তন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সংসদে বিবৃতি দিয়ে বিশ্বব্যাংক থেকে ঋণ না নিয়ে বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তকে চূড়ান্ত রূপ দিয়েছিলেন, সেদিন তিনি বলেছিলেন, তিন বছরের মধ্যে নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণ সম্পন্ন করা হবে। অথচ সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর।
আর সড়কপথ চালুর পর্বটি শুরু করতেই আরও সাড়ে সাত বছর লেগে যাচ্ছে। জাপানের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা মোতাবেক পদ্মা সেতু প্রকল্পটি অরিজিনালি ছিল ১ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের চাপাচাপিতে কয়েকবার ডিজাইন পরিবর্তনের মাধ্যমে সেতু প্রকল্পকে ২ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলারের ‘গ্র্যান্ড ব্রিজ প্রজেক্টে’ রূপান্তরিত করে ফেলা হয়েছিল। সেতুটিকে দোতলা করে নিচের তলায় রেলপথ সংযুক্ত করা হয়েছিল বিশ্বব্যাংকেরই চাপাচাপিতে, যদিও ওই অঞ্চলে তখন কোনো রেলপথ ছিল না। এখন রিভার ট্রেনিংসহ সেতুর নির্মাণ ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে গৃহীত প্রকল্প অনুসারে ঢাকা থেকে মাওয়া হয়ে সেতুর নিচতলা দিয়ে এই রেলপথ ফরিদপুরের ভাঙ্গা হয়ে পায়রা বন্দর ও যশোর পর্যন্ত বিস্তৃত করা হচ্ছে, যার প্রাক্কলিত ব্যয় দাঁড়াচ্ছে আরও ৩৯ হাজার কোটি টাকার বেশি। ওই রেলপথ প্রকল্পে চীনের ঋণ নেওয়া হচ্ছে ২১ হাজার কোটি টাকা। ২০২৪ সালের জুনে রেলপথ প্রকল্পটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন হওয়ার কথা। অতএব, পদ্মা সেতুর জন্য গত সাড়ে সাত বা আট বছরে দেশের জনগণ ৬৯ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ জোগান দিয়েছে কিংবা চীনের ঋণের দায়ে সম্পৃক্ত হয়ে গেছে, যা সুদ-আসলে বহু বছর ধরে জাতিকে কিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে। এখন যদি আবার এত উচ্চ হারে টোল দিয়ে এই সেতুর সড়কপথ ব্যবহার করতে হয়, তাহলে কি জনগণকে ডবল শাস্তি দেওয়া হচ্ছে না? সে জন্যই আমার সুস্পষ্ট দাবি, সেতুর সড়কপথ ব্যবহারের জন্য ঘোষিত টোলের হারকে সরাসরি অর্ধেকে নামিয়ে ফেলা হোক।
কেন এ কথা বলছি, তা বোঝার জন্য বাংলাদেশের ইতিহাসের এক দশক আগের সেতুসংক্রান্ত যুগান্তকারী ঘটনাপ্রবাহ স্মরণ করা যাক। ২০১২ সালের ২৯ জুন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিক যখন তাঁর মেয়াদ ফুরানোর আগের দিন ক্ষমতার চরম অপব্যবহার করে কথিত দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মা সেতু নির্মাণে বাংলাদেশকে প্রদেয় বিশ্বব্যাংকের ১.২ বিলিয়ন ডলারের ঋণ বাতিল করে দিয়েছিলেন, তখন বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদদের মধ্যে আমিই প্রথম সুস্পষ্ট আহ্বান জানিয়েছিলাম। দেশের বেশির ভাগ অর্থনীতিবিদ ওই পর্যায়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সামর্থ্য বাংলাদেশের নেই বলে তাঁদের সুনির্দিষ্ট মতামত ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু ২০১২ সালের জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা প্রদান করেছিলেন। তৎসত্ত্বেও সরকারের নীতিপ্রণেতাদের অনেকের ‘বিশ্বব্যাংক-ভক্তি’কে ওই পর্যায়ে টলানো যায়নি। ফলে নতজানু হয়ে বিশ্বব্যাংকের কৃপাভিক্ষার সিদ্ধান্তই নিয়েছিল সরকার। জনাব মুহিত বেশ কয়েক মাস ধরে প্রাণপণ প্রয়াস অব্যাহত রেখেছিলেন বিশ্বব্যাংকের নানাবিধ অন্যায় শর্ত মেনে বিশ্বব্যাংককে আবার সেতুর অর্থায়নে ফেরত আনতে। সাত মাস ধরে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ সরকারকে নাকে খত দেওয়ানোর কৌশল নিয়েছিল, তারা শর্তগুলো কঠোর থেকে কঠোরতর করছিল। বাংলাদেশ সরকার যতই কোণঠাসা হয়ে বিশ্বব্যাংকের শর্তগুলো মেনে নিয়ে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত বের করার জন্য মরিয়া প্রয়াস চালাচ্ছিল, ততই দর-কষাকষির খেলায় বিশ্বব্যাংক নতুন নতুন দাবি জানাচ্ছিল। এডিবি ও জাইকা নিজেদের ঋণ ছাড় করার শর্ত হিসেবে বিশ্বব্যাংকের ঋণপ্রস্তাব পুনর্বহাল জুড়ে দেওয়ার কারণেই বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে এতখানি বেকায়দায় ফেলতে সমর্থ হয়েছিল, তা বলা বাহুল্য। ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসের মধ্যে এসপার-ওসপার সিদ্ধান্ত জানানোর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হলে বিশ্বব্যাংকের তখনকার ঢাকা প্রতিনিধি সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁরা তা করবেন না। বাংলাদেশ ইচ্ছা করলে অন্য পথ দেখতে পারে। কূটনৈতিক শিষ্টাচারের তোয়াক্কা না করে তিনি বরং বিশ্বব্যাংকের অবস্থানকে এ দেশে ‘অত্যন্ত জনপ্রিয়’ বলে অভিহিত করে বক্তব্য দিতেও পিছপা হননি। জনাব মুহিত কর্তৃক ২০১৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পদ্মা সেতুর জন্য বিশ্বব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত জানানোর মাধ্যমে বিশ্বব্যাংকের এই চরম অপমানকর ঋণপর্বের যবনিকাপাত ঘটেছিল।
ওই সময় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীর মতো আমারও পরামর্শ ছিল: কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করে প্রকল্পটিকে ধাপে ধাপে বাস্তবায়িত করা হোক। সেতুর প্রস্তাবিত অঞ্চলে তখনো যেহেতু রেললাইন নেটওয়ার্ক ছিল না, তাই ভবিষ্যতের জন্য ওই কমপোন্যান্ট যোগ করার সুযোগ রেখে সেতুর ডিজাইন রিভাইজ করা হোক। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণের অনেক দিন পর চীনের ঋণে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা-যশোর-পায়রা রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প গৃহীত হয়েছিল। ২০২৪ সালে রেলপথটি চালু হওয়ার পর চীনের ২১ হাজার কোটি টাকা ঋণ সুদ-আসলে বার্ষিক কিস্তিতে পরিশোধের জন্য রেলপথের আয় প্রথম দিকে যথেষ্ট হবে না। তাই সেতুর সড়কপথ ও রেলপথ ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে আদায় করা টোলের অর্থ সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ ও ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যবহারের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। কিন্তু মূল পদ্মা সেতুর নির্মাণ খরচ যেহেতু দেশের জনগণ গত সাড়ে সাত বা আট বছর ধরে নির্বাহ করে চলেছেন, তাই সড়কপথের টোলের হার অযৌক্তিক পর্যায়ে নির্ধারণ না করে বর্তমান ফেরি পারাপারের ভাড়ার কাছাকাছি নির্ধারণের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আহ্বান জানাচ্ছি। সেতুর মূল ব্যবহারকারী দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলাদেশের জনগণ তাঁদের অঞ্চলের সন্তান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে এটুকু ‘রিলিফ’ প্রত্যাশা করলে কি অন্যায় হবে?
পদ্মা সেতু সম্পর্কিত আরও পড়ুন: