আজ ২৬ মে। গত বছরের এদিনে উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস। সেদিনের সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে লন্ডভন্ড হয়ে যায় খুলনার কয়রা উপজেলার ৪টি ইউনিয়ন। মুহূর্তেই বেড়িবাঁধের ১২টি পয়েন্ট ভেঙে লবণপানিতে তলিয়ে যায় ৫০টি গ্রাম। এদিন কোনো মানুষের প্রাণহানি না ঘটলেও ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পায়নি এ জনপদের গবাদিপশু, গাছপালা, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, ফসলি জমি, মৎস্যঘেরসহ বিপুল পরিমাণ সম্পদ। ইয়াসের এক বছর পার হলেও হাজারো মানুষ আজও ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারেননি।
সেদিনের সেই বিভীষিকাময় স্মৃতি বর্ণনা করে গাতীরঘেরী গ্রামের অলোকা রানী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ইয়াসের দিন সকাল থেকে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছিল। সঙ্গে হালকা বাতাস। দুপুরে রান্না করার জন্য ব্যস্ত ছিলাম। নদীতে তখন জোয়ার শুরু হয়। রান্না শেষ না হতে রাস্তা ওপর দিয়ে জল ঢুকতে ছিল। তাড়াতাড়ি আমরা সবাই মিলে রাস্তায় মাটি দেওয়া শুরু করি। রান্না করা ভাত খাওয়ার আগেই দেখি রাস্তা ভেঙে আমাদের ঘরবাড়ি সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। সেই দিন কিছুই নিতে পারিনি আমি।’
এ সময় তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে আরও বলেন, ‘যেটুকু জায়গা জমি ছিল, এর আগের আইলার তাণ্ডবে তা ভেঙে নদীতে চলে গেছে। ইয়াসের আগে তিন কাটা জমি কিনে একটা ঘর বেঁধেছিলাম, কিন্তু সে ঘরে একটি রাতও থাকতে পারিনি। সব ভাসিয়ে নিয়ে গেছে এবারের জলোচ্ছ্বাসে। সে সময় তিন দিন না খেয়েছিলাম। বাঁধ হয়েছে, কিন্তু ক্ষতি কাটিয়ে এখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারিনি।’
দশহালিয়ার গ্রামের মেহেরুন্নেছা বলেন, ‘বর্তমানে স্বামী-সন্তান নিয়ে খুব কষ্টে আছি। ইয়াসের ছয় মাস ধরে পানিবন্দী ছিলাম। আমাদের আর কোনো জায়গা ছিল না যে অন্য জায়গায় চলে যাব। গরিব মানুষ। দিনমজুর স্বামীর আয়ে কোনো রকম সংসার চলে। ইয়াসের ক্ষতি কাটিয়ে কবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরব, সেই চিন্তায় রাতে ঘুম আসে না।’
উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত বছরের ২৬ মে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে প্রবল জোয়ারে কপোতাক্ষ ও শাকবাড়িয়া নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে লবণপানিতে তলিয়ে যায় উপজেলার ৪টি ইউনিয়নের ৫০টি গ্রাম। ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও পূর্ণিমার অতিমাত্রায় জোয়ারের পানিতে উপজেলার শাকবাড়িয়া ও কপোতাক্ষ নদের প্রায় ৫০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ছাপিয়ে লোকালয়ে লবণপানি প্রবেশ করে। ভেঙে যায় বেড়িবাঁধের ১২টি পয়েন্ট। বিধ্বস্ত হয় ১ হাজার ২৫০টি ঘর। তলিয়ে যায় আড়াই হাজার চিংড়ির ঘের। যার ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৫ কোটি টাকা। ১৫ হেক্টর জমির কৃষি ফসল নষ্ট হয়।
উত্তর বেদকাশি ইউপি চেয়ারম্যান আলহাজ সরদার নুরুল ইসলাম বলেন, ‘দেখতে দেখতে ইয়াসের এক বছর হয়ে গেল। এখনো ক্ষতি কাটিয়ে অনেকেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি। এ অঞ্চলের মানুষ সেই দিন স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে, যেই দিন কপোতাক্ষ ও শাকবাড়িয়া নদীর বেড়িবাঁধ স্থায়ী বেড়িবাঁধে রূপ নেবে।’ কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইমতিয়াজ উদ্দিন বলেন, ইয়াসের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বিশেষ বরাদ্দ দিয়ে কয়রাকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। তিনি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে উপকূলীয় এলাকা ব্যাপক ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানান।
পাউবোর আমাদী উপবিভাগীয় শাখার কর্মকর্তা মো. মশিউল আবেদিন বলেন, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে কপোতাক্ষ ও শাকবাড়িয়া নদীর প্রায় ৫০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধের কিছু জায়গায় সংস্কার করা হয়েছে। কিছু জায়গায় কাজ চলছে। তা ছাড়া ভাঙনকবলিত অনেক এলাকায় টেন্ডারের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণকাজ খুব তাড়াতাড়ি শুরু হবে। এ ছাড়া সম্প্রতি যেসব বাঁধ ভয়াবহ ভাঙনের কবলে পড়েছে, সেগুলো মেরামতের জন্য সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অনিমেষ বিশ্বাস বলেন, ইয়াসে বিধ্বস্ত কয়রা এলাকার মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য সরকারিভাবে সার্বিক সহায়তা করা হচ্ছে।