যশোরে অসময়ের টানা তিন দিনের বৃষ্টিতে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন কৃষকেরা। বিশেষ করে শীতকালীন নানা সবজি, মসুর, সরিষা, পেঁয়াজ চাষিরা বিপাকে পড়েছেন বেশি। এ ছাড়া পাট ও বোরা ধান চাষিদের কপালেও পড়েছে চিন্তার ভাঁজ। ভেসে গেছে বহু কৃষকের খেতে কেটে রাখা আমন ধান। কষ্টের ধন শেষ মুহূর্তে এভাবে ভেসে যাওয়ায় মাথায় হাত পড়েছেন আমন চাষিদের। আর নানা সবজি, মসুর, সরিষা ও পেঁয়াজ চাষিদের স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে অঙ্কুরেই।
কৃষি বিভাগ বলছে, বৃষ্টি টানা তিন দিন স্থায়ী হওয়ায় অন্তত ৪০ ভাগ ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সময় মতো পরিচর্যা করা সম্ভব না হলে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে।
যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, জেলায় এবার ১২ হাজার ২৭০ হেক্টর জমিতে শীতকালীন সবজির আবাদ হয়েছে। এ ছাড়া প্রায় ১ হাজার হেক্টর জমিতে এখনো থেকে গেছে আগাম শীতকালীন নানা সবজি। সম্প্রতি ১৫ হাজার ৮৯০ হেক্টর জমিতে সরিষা, ৫ হাজার ৭০৫ হেক্টর জমিতে মসুর, ১৯ শ ২০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজের আবাদ করা হয়েছে।
সূত্রগুলো আরও জানিয়েছে, জেলায় চলতি আমন মৌসুমে ১ লাখ ৫৮ হাজার হেক্টর জমিতে ধানের আবাদ করা হয়েছে। যার প্রায় ৩০ ভাগ ধান এখনো মাঠে থেকে গেছে। প্রায় ১ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে তৈরি করা হয়েছে বোরোর বীজতলা। তা ছাড়া ৪৪৫ হেক্টর জমিতে আবাদ করা হয়েছে পাটের।
টানা বৃষ্টিতে এসব ফসল বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে। এখনো পর্যন্ত বিভিন্ন উপজেলা থেকে যে তথ্য পাওয়া গেছে, তা বিশ্লেষণ করে ক্ষতির পরিমাণ প্রাথমিকভাবে ৪০ শতাংশ বলছে দপ্তরটি। আগামী দুই–একদিনের মধ্যে ক্ষয়ক্ষতির পুরো চিত্র মিলবে বলে দাবি সূত্রগুলোর।
সদরের চুড়ামনকাটি গ্রামের বিল্লাল হোসেন জানান, তিনি ১০ কাঠা জমিতে মসুরের আবাদ করেছিলেন। এর পুরোটাই পানিতে তলিয়ে গেছে।
আমাদের চৌগাছা প্রতিনিধি আজিজুর রহমান জানিয়েছেন, টানা বর্ষণে চৌগাছায় সরিষা, মসুর, আলু, পেঁয়াজ, মরিচসহ সব ধরনের সবজি চাষিরাই ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
চৌগাছা উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য প্রদানকারী কর্মকর্তা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা রাশেদুল ইসলাম জানান, সোমবার পর্যন্ত তাঁদের হিসেবে ১১.২৫ হেক্টর বোরো বীজতলা, ১০ হেক্টর মসুর, ২. ৫০ হেক্টর গম, ৫০ হেক্টর সরিষা, ৪০ হেক্টর বিভিন্ন ধরনের সবজি, ৪৭ হেক্টর গোলআলু, ১৫ হেক্টর পেঁয়াজ, ১২ হেক্টর মরিচ সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৩০ হেক্টর বোরো বীজতলা পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। রাতের মধ্যে পানি নিষ্কাশন না হলে বা আরও বৃষ্টি হলে এই ৩০ হেক্টরের সঙ্গে আরও বেশি পরিমাণ বীজতলা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যাবে। এ ছাড়া এই বৃষ্টিতে আলু সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে তিনি জানান।
পৌরসভার বেলেমাঠ গ্রামের আসগর আলী জানান, তিনি দেড় বিঘা জমিতে পেঁয়াজ এবং এক বিঘা আলু লাগিয়েছিলেন। এতে শুধু বীজ কিনতে খরচ হয়েছে ৬৫ হাজার টাকা। এ ছাড়া সার, শ্রমিক এবং জমির খরচ তো আছেই।
আসগর আলী বলেন, ‘আমার জমির ওপর দিয়ে এখনো পানির ও স্রোত যাচ্ছে। তিনি যে মাঠে এই আবাদ করেছেন সে মাঠের এক থেকে দেড় শ বিঘা জমির ফসল সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে।’
একই গ্রামের হানেফ আলী জানান, তিনি বাঘারদাড়ী মাঠে এক বিঘা সরিষা করেছিলেন। সরিষায় ফুলও এসেছিল। বৃষ্টিতে তাঁর সব নষ্ট হয়ে গেছে।
আমাদের ঝিকরগাছা প্রতিনিধি মাসুদুর রহমান জানিয়েছেন, টানা বৃষ্টিতে ঝিকরগাছাতেও সবজির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। উপজেলার বল্লা গ্রামের কৃষক শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘এক বিঘা জমির সরিষা খেত পানি বেঁধে নষ্ট হয়ে গেছে। আরও এক বিঘা শিমের খেতেও বৃষ্টির পানি জমে ছিল। পানি সরিয়ে দিয়েছি তারপরও শিম খেত বাঁচবে না।’
উপজেলার রাজাপুর গ্রামের কৃষক আব্দুস সামাদ বলেন, ‘বৃষ্টির পানিতে মসুর খেত একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। বৃষ্টি আরও একদিন থাকলে সব রবিশস্যসহ অন্যান্য ফসলেরও ব্যাপক ক্ষতি হবে।’
আমাদের মনিরামপুর প্রতিনিধি আনোয়ার হোসেন উপজেলা কৃষি অফিসের বরাত দিয়ে জানিয়েছেন, তিন দিনের বৃষ্টিতে আমন নিয়ে বিপাকে পড়েছেন মনিরামপুরের কৃষকেরা। রোব ও সোমবারের টানা বৃষ্টিতে পানিতে ভাসছে হাজার হাজার বিঘার পাকা ধান। কারও ভাসছে কেটে রাখা ধান, কারও ডুবেছে আমন খেত। কপালে ভাঁজ পড়েছে সরিষা ও মসুর চাষিদের। তলিয়ে গেছে বোরোর আগাম বীজতলা।
উপজেলা কৃষি দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এখনো ৫ ভাগ পাকা আমন ধান খেতে রেয়ে গেছে। যেগুলো নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন কৃষকেরা।
গতকাল সোমবার সরেজমিন দেখা গেছে, উপজেলার রঘুনাথপুর বিলে ২৫ কাঠা জমির কেটে রাখা ধান ভাসছে মাহমুদকাটি গ্রামের চাষি জাহাঙ্গীর মিস্ত্রির। হাঁটু পানিতে কাটা ধান ভাসছে একই বিলের চাষি জাকির হোসেন, মইনুদ্দিন হোসেন, আল-আমিন, ইউসুফ আলী, ও শহিদুল ইসলামের।
আমাদের কেশবপুর প্রতিনিধি কামরুজ্জামান রাজু জানিয়েছেন, বৃষ্টিতে ধানের বীজতলা, সরিষা, মসুরসহ সবজির অনেক খেত নষ্ট হয়ে গেছে। উপজেলা কৃষি দপ্তর জানিয়েছে, এই বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে কৃষকের ব্যাপক ক্ষতি হবে।
কেশবপুর উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, টানা ৩ দিনের বৃষ্টিপাতে ৯০ হেক্টর বোরো ধানের বীজতলার ভেতর ৮৫ হেক্টর, ৮৬০ হেক্টর সরিষা, ৯৩ হেক্টর মসুর ও ৩৫০ হেক্টর সবজি তলিয়ে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ঋতুরাজ সরকার বলেন, ‘এভাবে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে ধানের বীজতলা, সরিষা, মসুরসহ সবজি খেত নষ্ট হয়ে কৃষকের ব্যাপক ক্ষতি হবে।’
এ ছাড়া অভয়নগর, কেশবপুর, শার্শা, বাঘারপাড়া উপজেলাতেও টানা বৃষ্টিতে ক্ষতির মুখে পড়েছেন কৃষকেরা।
যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ‘পুরো বর্ষা মৌসুমে যে ক্ষতি হয়নি, অসময়ের তিন দিনের এ বৃষ্টিতে তার চেয়েও বেশি ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন কৃষকেরা। কেননা, বৃষ্টি টানা ও স্থায়ী হওয়ায় মাঠগুলোতে পানি জমে গেছে। যার প্রভাব আরও কয়েক দিন থাকতে পারে।’
উপপরিচালক বাদল চন্দ্র বিশ্বাস আরও বলেন, ‘পানি নেমে গেলেও গাছে পচনসহ নানা ধরনের রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়তে পারে। এ সময়ে কৃষককে সঠিকভাবে গাছের পরিচর্যা করতে হবে। মাঠ থেকে পানি অপসারণের পাশাপাশি প্রয়োজন অনুযায়ী সার ও কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে। এ ছাড়া পরিস্থিতি মোকাবিলায় কৃষি অধিদপ্তরের সবগুলো টিম মাঠে নামানো হয়েছে।’