আবু নাঈম সোহাগ গত পরশু বিকেল পর্যন্তও ছিলেন বাফুফের সাধারণ সম্পাদক। হোয়াটসঅ্যাপ বার্তায় ক্রীড়াসংশ্লিষ্ট সবাইকে জানিয়েছিলেন বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা। পয়লা বৈশাখের সন্ধ্যায় পাল্টে গেল দৃশ্যপট। বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফা জানিয়ে দেয়, আর্থিক জালিয়াতি ও অনিয়মের দায়ে দুই বছরের জন্য ফুটবলের সব রকম কার্যক্রম থেকে নিষিদ্ধ সোহাগ। হারিয়েছেন বাফুফের সাধারণ সম্পাদকের পদও।
ফিফার ওই এক চিঠিতেই চূড়া থেকে পতন, বাংলাদেশের ক্রীড়া ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারির দায় এখন সোহাগের কাঁধে। আন্তর্জাতিক ক্রীড়া আদালতে আপিল করে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে না পারলে দুই বছরে আর ফুটবলে ফেরা হচ্ছে না ২০১১ সাল থেকে বাফুফের সাধারণ সম্পাদকের পদে থাকা সোহাগের।
বাফুফের সাধারণ সম্পাদকের পদে থেকে কী কী অনিয়ম করেছেন সোহাগ ও বাফুফের কর্মকর্তারা, সেটা ৫১ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে ফিফা। বিশাল এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে, বাফুফেতে যেসব দুর্নীতি হয়েছে, সেটা যেন রীতিমতো ‘পুকুরচুরি’! নিরীক্ষা শেষে প্রায় সাড়ে ৬ কোটি টাকার আর্থিক অসংগতি খুঁজে পেয়েছে ফিফা। ক্রীড়াসামগ্রী থেকে শুরু করে বল কেনা, বিমানের টিকিট কিনতে ভুয়া প্রতিষ্ঠান দেখানো, ঘাস কাটার যন্ত্র, পানির সংযোগসহ নানা খাতের দরপত্রে গরমিলের প্রমাণ দেখানো হয়েছে সেই প্রতিবেদনে।
শুধু কেনাকাটাতেই নয়, বাফুফের জন্য বরাদ্দ বার্ষিক অনুদানেও আছে নয়ছয়ের প্রমাণ। ফিফার নৈতিকতা বিষয়ক কমিটির ইনভেস্টিগেটরি চেম্বার বেশ কিছু লেনদেন বিশ্লেষণ করে ৫ লাখ ৯৭ হাজার ৮৪ মার্কিন ডলার আর্থিক অসংগতি খুঁজে পেয়েছে।
ফিফার তদন্তে তিনটি বড় অনিয়ম দেখা গেছে। এর মধ্যে আছে ফিফার তহবিলের জন্য নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্ট থেকে নগদে টাকা উত্তোলন, ফিফা সম্পর্কিত প্রকল্প বা প্রোগ্রামে অন্য অ্যাকাউন্টের টাকা ব্যবহার এবং ফিফা তহবিলের টাকা ভিন্ন খাতে ব্যয় করা। ২০১৬ থেকে ২০১৯ সালের কেন্দ্রীয় পর্যালোচনা এবং নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান বিডিও কর্তৃক ২০১৭ থেকে ২০১৯ সালের পুঙ্খানুপুঙ্খ নিরীক্ষা বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
এ মাসেই আর্থিক সংকট দেখিয়ে নারী ফুটবল দলকে মিয়ানমারে খেলতে পাঠায়নি বাফুফে। অথচ ফিফার প্রতিবেদন বলছে, অনিয়ম হয়েছে এ খাতেও। নারী ফুটবলে ভ্রমণ ও বেতন বাবদ ১ লাখ ৭ হাজার ৬৩৪ ডলার খরচের কোনো প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখায়নি বাফুফে। জাতীয় দলের কোচ ও টেকনিক্যাল ডিরেক্টরকে ৪৪ হাজার ১০০ ডলার বেতন নগদ আর ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে দেখিয়েও ‘সফল’ হতে পারেননি সোহাগ।
কেনাকাটা নিয়ে বাফুফেতে যে নয়ছয় হচ্ছে, সেটা প্রথম জানা যায় গত বছরের শেষ দিনে। শোকজ করা হয় সোহাগসহ চার কর্মকর্তাকে। তাঁদের কারণ দর্শানোর নোটিশে সন্তুষ্ট হতে পারেনি বাফুফে। ফেডারেশনের একাধিক কর্মকর্তাকে নিয়ে এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে জুরিখে ফিফা সদর দপ্তরেও গিয়েছিলেন সোহাগ। তখনই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছিল শাস্তি পেতে যাচ্ছেন তিনি। তবে নিষেধাজ্ঞায় যে পড়তে যাচ্ছেন, সেটা হয়তো নিজেও অনুমান করতে পারেননি সোহাগ। বাফুফের সাংগঠনিক কাঠামোর প্রভাবশালী কর্তা হিসেবে সব দায় তাঁকেই নিতে হয়েছে। বাফুফের এক কর্মকর্তা বলছিলেন, ‘তিনি ভীষণ কর্মঠ ছিলেন। বাকিদের যেন কোনো ক্ষতি না হয়, সব দায় একাই নিয়েছেন।’
সাধারণ সম্পাদকের আর্থিক অনিয়মের দায় বর্তায় সভাপতি কাজী সালাউদ্দিনের কাঁধেও। ফিন্যান্স কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে এসব ‘ভুয়া’ ভাউচারে স্বাক্ষর করেছেন সহসভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী। দায় আছে প্রধান অর্থ কর্মকর্তা আবু হোসেনেরও। দুর্নীতির দায়ে শুধু শাস্তি পেয়েছেন সোহাগই।
এক দশকে সালাউদ্দিনের ছায়ায় বাফুফের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়েছেন সোহাগ। সোহাগকে নিয়ে বাফুফে সভাপতি গতকাল সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘ওরা (ফিফা) কিন্তু বলেনি আর্থিক অনিয়ম। ফিফার রিপোর্টে আর্থিক অনিয়ম বলা হয়নি। ওরা কোড অব এথিক্স এবং রেসপনসিবিলিটি নিয়ে বলেছে। যা-ই বলা হয়েছে, সবই এখানে আসবে। এখানে লুকানোর কিছু নাই। তবে কিছু বলার আগে আমার সবার সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
সোহাগ মনে করেন, ফিফার এই সিদ্ধান্ত ‘ত্রুটিপূর্ণ’ ও ‘অনুমাননির্ভর’। এবং আন্তর্জাতিক ক্রীড়া আদালতে তিনি আপিল করবেন বলে জানানো হয়েছে তাঁর আইনজীবীর পক্ষ থেকে। আইনজীবীর বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘নিয়ম অনুযায়ী জনাব সোহাগ এই পক্ষপাতদুষ্ট রায়ের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ক্রীড়া আদালতে (সিএএস) আপিল করবেন। এটি একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান।’
আপিল করে সোহাগ নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারবেন কি না সেটা ক্রীড়া আদালতের রায়েই জানা যাবে। তবে তাঁর কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশের ফুটবলে বড় কালিমা লেগেছে বলে মনে করেন ফুটবলসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।