প্রশ্ন: ই-কমার্স সিস্টেমে অনেক সময় দেখা যায়, বিক্রেতা পণ্যের ছবি বা ভিডিও পোস্ট করেন, সঙ্গে পণ্যের গুণাগুণও বলে দেন, তবে দাম গোপন রাখেন। দাম জানতে চাইলে ‘চেক ইনবক্স’ বা ‘ইনবক্স প্লিজ’ ইত্যাদি উত্তর দিয়ে ইনবক্সে দাম জানান। এ ক্ষেত্রে দেখা যায়, কোনো কোনো বিক্রেতা সবার কাছে একই মূল্য চাইলেও বেশির ভাগই ক্রেতাভেদে দাম কমবেশি করেন। বিষয়টি সম্পর্কে ইসলামি শরিয়তের বিধান কী? বিস্তারিত জানতে চাই।
আবদুর রহমান, ঢাকা
উত্তর: ইসলামি শরিয়ার আইন মোতাবেক, বেচাকেনার চুক্তি শুদ্ধ হওয়ার জন্য ক্রেতা-বিক্রেতার পণ্যের দাম জানা থাকা অপরিহার্য শর্ত। (আল-মাওসুআহ আল-ফিকহিয়্যাহ: ৯ / ১০০)। পণ্যের বিক্রয়মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিক্রেতা স্বাধীন। একই পণ্যের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির কাছে ভিন্ন ভিন্ন দামও চাইতে পারেন। তবে বিক্রয়মূল্য নির্ধারণে দুটি বিষয় লক্ষ রাখতে হবে—
এক. বাজারমূল্য: জনগণ সাধারণত যে মূল্যে একটি পণ্য কেনাবেচা করে, সেই মূল্যই নির্ধারণ করা। একে ‘সুমুন আল-মিসিল’ বা অনুরূপ দ্রব্যমূল্য বলা হয়। পণ্যের গুণাগুণের তারতম্য অনুযায়ী একই জাতীয় পণ্যের একটি যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করতে হবে, যা প্রচলিত বাজারদরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
দুই. ন্যায্যমূল্য: বিক্রেতা মূল্য নির্ধারণের সময় পণ্যের গুণাগুণ ছাড়া চাহিদার বৃদ্ধি বা পণ্যের সংকট ইত্যাদি কারণে মূল্য বৃদ্ধি করবেন না।
ইনবক্সে দাম জানালে সমস্যা আছে কি: ওয়েব পেইজ বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পণ্যের সামগ্ৰিক বর্ণনার সঙ্গে দাম উল্লেখ করা যায়। এতে গ্ৰাহকের জন্য সহজতর হয়। দাম উল্লেখসহ পণ্যের বর্ণনা দেওয়া থাকলে শরিয়তের দিক থেকে তা বিক্রয় চুক্তির অফার হিসেবে বিবেচিত হয়। গ্রাহক তাতে সম্মতি দিলেই অ্যাকসেপ্ট হয়ে বিক্রয় চুক্তি সম্পাদন হয়ে যাবে। কিন্তু পণ্যের দাম উল্লেখ না করা থাকলে তা অফার বিবেচিত হবে না; বরং তা হবে ‘ইনভাইটেশন টু নেগোশিয়েট’ বা দাম নির্ধারণের আমন্ত্রণ। এতে অনেক গ্ৰাহক বিরক্ত হন ঠিকই, কিন্তু শরিয়তের দিক থেকে তা নিষিদ্ধ নয়। ‘বিক্রেতা যখন দাম গোপন করে ইনবক্সে জানান এবং ক্রেতা সন্তুষ্ট হয়েই তা কিনে নেন, তাহলে তাতে কোনো সমস্যা নেই। এটা প্রতারণা বিবেচিত হবে না।’ (ইসলামকিউএ) বিক্রেতা ও গ্ৰাহক গোপনে দাম নিয়ে সমঝোতা করলে তাতে শরিয়তের কোনো নিষেধ নেই।
দাম কমবেশি করা কি প্রতারণা: বিক্রেতা পরিচিত, আত্মীয়স্বজন কিংবা প্রতিবেশী থেকে মূল্য কম নিতে পারেন। কিন্তু প্রোফাইল ভিজিট করে অপেক্ষাকৃত কম বুদ্ধিমান লোকজন থেকে বেশি দাম নেওয়া প্রতারণার শামিল। যদি বাজারে পণ্যের দাম বিক্রেতা যা বলেছে তার চেয়ে কম বা পণ্যটির গুণাগুণ অতিরঞ্জিত করে বলা হয়, যা বাস্তব নয়, তাহলে তা নবী (সা.) কর্তৃক ব্যবসায়িক কাজে নিষিদ্ধ ‘আল-গাশ’ বা প্রতারণা বিবেচিত হবে।
চাহিদা বৃদ্ধি ও জোগানের স্বল্পতার কারণে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি দাম চাওয়া শরিয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে নিষিদ্ধ নয়। পাইকারি ও খুচরা প্রতিটি বাজারের আলাদা দাম, পণ্যের ব্যাপক জোগান ও দুষ্প্রাপ্যতার সময়কালে আলাদা দাম শরিয়তে নিষিদ্ধ নয়। (ফাতওয়া ইসলামিয়্যাহ: ২ / ৭৩৯) তবে সব সময় নবী (সা.) ভোক্তাদের প্রতি সহমর্মী ও সহনশীল হতে উৎসাহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি বেচাকেনা ও ঋণের তাগাদায় নম্র ব্যবহার করে, আল্লাহ তাআলা তার ওপর রহম করেন।’ (বুখারি, আস-সহিহ: ১৯৪৬)
বাংলাদেশের আইনের সঙ্গে সমন্বয় যেভাবে:
বাংলাদেশ আইনে বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি কোনো আইন বা বিধি দ্বারা আরোপিত বাধ্যবাধকতা অমান্য করিয়া তাহার দোকান বা প্রতিষ্ঠানের সহজে দৃশ্যমান কোনো স্থানে পণ্যের মূল্যের তালিকা লটকাইয়া প্রদর্শন না করিয়া থাকিলে তিনি অনূর্ধ্ব এক বৎসরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’ (২০০৯ সালের ভোক্তা-অধিকার আইন, ধারা ৩৮)
ইসলামি শরিয়তে জায়েজ থাকলেও আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সতর্কতা ও জনগণের কল্যাণ বিবেচনায় পণ্যের মান ও দাম নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্র নজরদারি ও আইন প্রণয়ন করতে পারে। যদি শরিয়তের সঙ্গে এমন আইনের কোনো বিরোধ না হয়, তবে তা শরিয়তের পরিভাষায় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের অন্তর্ভুক্ত হবে, যা পরিপালন করা শরিয়তে ওয়াজিব বা অপরিহার্য। সুতরাং বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী প্রতিটি পণ্যের সামগ্ৰিক বর্ণনার সঙ্গে প্রকাশ্যে মূল্য উল্লেখ করাও জরুরি। ইসলামি শরিয়তও বিষয়টি সমর্থন করে।
উত্তর দিয়েছেন
ড. মুহাম্মদ তাজাম্মুল হক (সিএসএএ)
সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
ও
মোহাম্মদ আবদুল হান্নান (সিএসএএ)
হেড অব ইসলামিক ফাইন্যান্স, আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিডেট