গত বছর সেপ্টেম্বরে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ। সফরের ফাঁকে ১০ সেপ্টেম্বর তিনি গিয়েছিলেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী ও জলের গান ব্যান্ডের প্রধান রাহুল আনন্দের ধানমন্ডির বাড়িতে। গান শুনেছেন জলের গানের স্টুডিওতে। সেখানে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টকে বাংলা গান ও বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন রাহুল। তাঁর তৈরি অসংখ্য বাদ্যযন্ত্র দেখে মুগ্ধ হন প্রেসিডেন্ট। সময় কাটিয়েছেন প্রায় ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিট। সেই বাড়িটি ৫ আগস্ট সোমবার বিকেলে পুড়ে ছাই হয়ে গেল। আর রাহুলের তৈরি অসংখ্য বাদ্যযন্ত্র লুট করে নিয়ে গেল দুর্বৃত্তরা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কারণে ওই দিন পদত্যাগ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের সরকারের পতনের খবর পেয়েই উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠে দেশবাসী। অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটে সারা দেশে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের অফিস ও বাসাবাড়ি থেকে লুট হয়ে যায় আসবাব ও জিনিসপত্র। ওই দিন বিকেল আনুমানিক ৪টায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে অগ্নিসংযোগ করা হয়, একই সঙ্গে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় জলের গানের রাহুলের বাসভবনটি। গতকাল এ বিষয়ে ফেসবুকে পোস্ট শেয়ার করে ঘটনা সম্পর্কে জানিয়েছে জলের গান। সেখানে তারা লিখেছে, ‘জলের গানের ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের এই বাড়িটি শুধু রাহুল আনন্দের বসতবাড়ি ছিল না, ছিল পুরো দলটির স্বপ্নধাম, আনন্দপুর। যেখানে তৈরি হয়েছে কত গান, কত সুর আর দাদার ভাবনাপ্রসূত শত শত বাদ্যযন্ত্র।
জলের গানের অফিশিয়াল স্টুডিও হিসেবে ব্যবহৃত হতো বাড়িটি। দলের সবার দলগত সংগীত চর্চা থেকে শুরু করে সব স্টুডিওওয়ার্ক—রেকর্ডিং, মিক্সিং, এডিটিং এখানেই হতো।... রাহুল আনন্দ ও উর্মিলা শুক্লার (রাহুলের স্ত্রী) এবং আমাদের সকলের প্রিয় জলের গানের এই বাড়িটি আর নেই। আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সৃষ্টিকর্তার কৃপায় এবং আশীর্বাদে বাড়ির সকল সদস্য নিজের প্রাণ হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন এবং এখন নিরাপদে আছেন। কিন্তু, রাহুলদা এবং আমাদের দলের সকল বাদ্যযন্ত্র, গানের নথিপত্র এবং অফিশিয়াল ডকুমেন্টস ছাড়াও, দাদার পরিবারের খাট-পালং, আলনা আর যাবতীয় সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে! সকলের জন্য নিরন্তর ভেবে যাওয়া মানুষটিকে পরিবারসহ এক কাপড়ে তাঁর নিজ ঘর থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। এর প্রভাব হয়তো আজীবন লালিত থাকবে তাঁর সন্তানের (তোতা) মনে; যার বয়স কি না মাত্র ১৩ বছর।’
পুরো ঘটনা সম্পর্কে জানতে রাহুলের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাঁকে পাওয়া যায়নি। তবে কথা হয় জলের গানের সদস্য রানা সারোয়ারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বিকেল ৪টার দিকে একদল লোক এসে বাড়ির সবাইকে বের করে দেয়। তারা জানায়, বাড়িতে আগুন দেওয়া হবে। খবর পেয়ে আমরা ওখানে গিয়ে দেখি বাড়িতে আগুন জ্বলছে। অনেকেই রাহুলদাকে শারীরিকভাবে আঘাত করেছে। তবে কয়েকজন লোক তাঁকে সেইফ করার চেষ্টা করেছে, নিরাপদে বের হতে সহায়তা করেছে।’ আলোচনা প্রসঙ্গে রানা বলেন, ‘আমাদের কেন যেন সন্দেহ হয়, ঘটনাটা টার্গেট করেই ঘটানো হয়েছে। কারণ, এ ধরনের অভ্যুত্থানের সময় মাইনরিটিদের ওপর কমবেশি আক্রমণ হয়, রাহুলদা সেই টার্গেটে পড়তে পারেন। তা ছাড়া এই বাড়িটা প্রধান সড়ক থেকে বেশ ভেতরে, সাধারণ মানুষের এই বাড়ি চেনার কথা নয়। তবে এটা আমাদের ধারণা, নিশ্চিত কিছু নয়।’
জলের গানের সাবেক সদস্য সংগীতশিল্পী কনক আদিত্যর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘ঘটনা ঘটেছে গতকাল (পরশু), আমি পরে শুনেছি। রাহুলের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। সে নিরাপদে আছে, সুস্থ আছে। তবে মানসিক ট্রমার মধ্যে আছে।’
কারা লাগিয়েছে আগুন? বাদ্যযন্ত্রগুলো কারা লুট করেছে? জানতে চাইলে রানা বলেন, ‘এত দিনের স্বৈরশাসনের অবসানে সারা দেশের মানুষই আনন্দে রাস্তায় নেমেছিল। এ ধরনের সময়ে এমন ঘটনা ঘটে, সেটা আমরা অস্বীকার করছি না। তবে যারা এসেছিল, তাদের কাউকে চিনতে পারিনি। অপরিচিতজন। গণভবনে যেমন করে সমস্ত আসবাব, জিনিসপত্র লুট করে নিয়েছে সাধারণ উৎসুক জনতা, তেমন করেই রাহুলদার বাড়ির আসবাব আর বাদ্যযন্ত্রগুলো লুট করে নিয়ে গেছে।’
এদিকে, সকল শিল্প, স্থাপনা, শিল্পাঙ্গন ও ভাস্কর্য ধ্বংসের বিরুদ্ধে অবস্থান এবং রাহুল আনন্দের বাড়ী, তাঁর সৃষ্টি বাদ্যযন্ত্র লুট ও পুড়িয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে শিল্পীদের নিয়ে আজ বিকেল সাড়ে ৪টায় শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে অবস্থান নেওয়ার কথা জানিয়েছে নাট্যদল প্রাচ্যনাট। ঢাকার বাইরে সমমনা সংস্কৃতি কর্মীদেরও যার যার অবস্থানে থেকে সংহতি জানানোর আহ্বান জানানো হয়েছে।