ইয়াহ্ইয়া মারুফ, সিলেট
১৫ অক্টোবর আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস। এই দিবসের কথা জানেন না নাজমা বেগম (৩০) ও বাবলী বেগম (২৫)। সিলেট নগরের শেখঘাট এলাকার একটি লাকড়ির মিলে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেন দুজন। দক্ষিণ সুরমা উপজেলার লাইয়াই গ্রামের বাসিন্দা নাজমা, পাশের গ্রাম বরইকান্দির বাবলী।
পনেরো বছর ধরে লাকড়ির মিলে লাকড়ি বানানোর কাজ করেও মুক্তি মেলেনি নাজমার। বিয়ের বছরখানেক যেতে না-যেতেই স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। আবারও যোগ দেন ধুলো আর তুষের লাকড়ির মিলে। ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়ে শহরের বাসাবাড়িতে কাজের মাধ্যমে শুরু নাজমার জীবনসংগ্রাম।
আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস নিয়ে কথা হচ্ছিল নাজমার সঙ্গে। পাশেই দাঁড়ানো বাবলী এ কথা শুনে হাসতে হাসতে ঢলে পড়েন। প্রতিবছর আন্তর্জাতিক গ্রামীণ নারী দিবস বেশ ঘটা করে পালিত হলেও নাজমা ও বাবলীর মতো প্রান্তিক নারীরা দিবসটির কথা জানেন না।
বাবলী বেগম বলেন, ‘মিলে নারীরা কাম করলে দেয় আড়াই শ টাকা। পুরুষেরা পায় এর দ্বিগুণ। সবাই খালি নারীরে ঠকায়। হেরার (তাদের) বুঝা উচিত, আমরা তো শুধু নারী না। মানুষও। ৯ ঘণ্টা কাম করলেও আমরার কোনো ছুটি নাই। কাজ করলে পেটে ভাত পড়ে, নাইলে না।’
নিবিষ্ট মনে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার কালাইরাগে বালু চাকার কাজ করছিলেন শিলা বিশ্বাস, নিরতি বিশ্বাস ও কেবল বিশ্বাস। শিলা ও কেবল স্বামী-স্ত্রী। আর নিরতি কেবলের বোন। তিরিশ ও চল্লিশের কোঠায় বয়স তাঁদের। উপজেলার খাগাইলবাজার এলাকার পূর্ণছগাঁও গ্রামে বাড়ি। দুই বছর আগে তুফানে ঘর ভেঙে গেছে। এরপর থেকেই বালুচর এলাকার একটি বাসায় ৬০০ টাকা মাসিক ভাড়ায় দুই ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে থাকেন শিলা ও কেবল দম্পতি। বড় ছেলে আনন্দকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন। বাকি দুই ছেলেমেয়ে ছোট ছোট। দুজনে বালু চেকে প্রতিদিন ৩০০-৪০০ টাকা পান। তা দিয়ে খেয়ে বাঁচাই দায়। এ জন্য ঘরও করতে পারছেন না। কেবল বিশ্বাস বলেন, ‘বউ আমারে সাহায্য না খরলে উপাস মরলামনে। বউয়ের কাছে চিরদিন ঋণী তাখমু।’ শিলা বলেন, ‘জামাই অসুস্থ, এ জন্য ঘর থাকি এখলা বের ওইতে দেই না। অন্য কাজে গেলে হয়তো আরও বেশি রুহি করতে পারত। কিন্তু এটাতে কষ্ট কম। এ জন্য আমিও তাকে সাহায্য করতে পারি।’
প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বিরতিহীন কাজ করেন স্বামী-স্ত্রী। কাজও করেন সমান। অথচ স্বামীর চেয়ে অনন্ত ১০০ টাকা মজুরি কম পান শিলা।
এর তিন ভাগের এক ভাগ নারীশ্রমিক। শুষ্ক মৌসুম ছাড়া বছরের ৬ থেকে ৭ মাস পাহাড়ি ঢলে কয়লা নেমে আসে।
তাহিরপুর সীমান্তের বাগলি ছড়ায় কয়লা খুঁজছিলেন রহিমা বেগম। তিনি জানান, সারা দিন পানিতে ভেসে আসা কয়লা ধরে বিকেলে বিক্রি করলে পান ১৮০ থেকে ২০০ টাকা। সেই টাকায় ছেলেমেয়ের জন্য চাল-ডাল কিনে বাড়ি ফেরেন। সকালে আবার এসে পানিতে নামেন। দিনের পর দিন এ চক্রে চলতে থাকে জীবন।
গ্রামীণ নারীদের এই পৌনঃপুনিক গল্প পুরো দেশের। নারী-পুরুষ সমান অধিকারের কথা বললেও নারীরা, বিশেষত গ্রামের নারীরা এখনো যে শোষিত শ্রেণিতে রয়ে গেছেন, সে বিষয়ে সন্দেহের তেমন অবকাশ নেই।