সম্পাদকীয়
এবার মোরসালিনের স্ত্রীও স্বামী হত্যার বিচার চাইলেন না। ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী আর নিউমার্কেটের ব্যবসায়ীদের মধ্যে দুদিনব্যাপী যে সংঘর্ষ হয়ে গেল, তার শিকার ছিলেন মোহাম্মদ মোরসালিন। একই ঘটনায় এক দিন আগে নিহত হয়েছেন নাহিদ হাসান। নাহিদের মা একই কথা বলেছিলেন। ছেলে হত্যার বিচার চান না তিনি। কারণ হিসেবে বলেছিলেন, মামলা চালানোর টাকা তাঁদের নেই। নাহিদ ছিলেন পরিবারের উপার্জনক্ষম সদস্য। মাত্র সাত মাস আগে বিয়ে হয়েছিল তাঁর।
টাকা নেই, মামলা চালাতে পারবেন না, এ কথা বলেছেন নাহিদের মা। কিন্তু এটাই বিচার না চাওয়ার অন্তর্নিহিত কারণ নয়। আসলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও বিচারের নিশ্চয়তা নিয়ে সন্দেহ সৃষ্টি হলেই কেবল একের পর এক মানুষ বলতে পারেন, তাঁরা বিচার চান না।
কিছুদিন আগে এই রাজধানীতেই একজন রাজনীতিবিদ হত্যাকাণ্ডের সময় রিকশা আরোহী সামিয়া আফরিন প্রীতি নিহত হয়েছিলেন। তাঁর পরিবারও একইভাবে মামলা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। বলেছিলেন, ‘আল্লাহর কাছে বিচার দিয়ে রাখলাম।’ বিচারব্যবস্থার প্রতি কতটা অনাস্থা থাকলে এ ধরনের কথা বলতে পারে মানুষ, সেটা বিবেচনায় নিতে হবে। পরপর তিনটি ঘটনায় তিনটি পরিবারের পক্ষ থেকে যখন নিজ সন্তান হত্যার বিচার চাওয়া হয় না, তখন বুঝতে হবে গলদ অন্য জায়গায়। সন্তান হত্যার প্রতিকার চাইবেন না, অপরাধীর বিচার চাইবেন না, এ রকম মানসিকতা স্বাভাবিক নয়। কেন এই অস্বাভাবিকতার সৃষ্টি হলো, তা তলিয়ে দেখা দরকার।
কেন নিহতদের পরিবারগুলো নির্দ্বিধায় বিচার না চাওয়ার কথা বলছে, সেটা খতিয়ে দেখা না হলে বিপদে পড়বে এই রাষ্ট্র। রাষ্ট্র ও বিচারব্যবস্থার প্রতি একধরনের অনাস্থারই প্রকাশ ঘটে এতে। ফলে এই কথাগুলোকে সরল বাক্য হিসেবে গ্রহণ করার কিছু নেই। বাক্যগুলোর ভেতরে প্রবেশ করলে দেখা যাবে কত বড় হতাশা, অসহায়ত্ব আর পরাজয় লেখা আছে তাতে। রাষ্ট্রের একজন সাধারণ নাগরিক যখন বুঝতে পারেন, বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে কাঁদে, তখন তার দায় গিয়ে বর্তায় প্রচলিত শাসনব্যবস্থার ওপর। দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের জায়গায় যদি কোনো কারণে দুষ্টরাই বহু জায়গায় ছড়ি ঘোরাতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে, তখন সেই অনাস্থা অনেক বেশি পোক্ত হয় সাধারণ মানুষের মনে।
এটা সহজবোধ্য বিচারহীনতার আশঙ্কায় পরিবারগুলো বিচারের ব্যাপারে ‘না’ বলছে। তাদের আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য একটা কাজই করা সম্ভব। তা হলো, যত দ্রুত সম্ভব অপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো। তারপরও কথা থেকে যায়। হারানো মানুষটিকে তো আর ফিরে পাওয়া যাবে না। তাই ভবিষ্যতে এই হতাশা কাটিয়ে ওঠার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সরকার এবং বিচারব্যবস্থার কাছে সাধারণ মানুষ আশা করে, দুষ্টের দমন হবে যথাযথভাবে, অন্যায় করে কেউ পার পাবে না।
ভুক্তভোগীর মনে সেই আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা খুব সহজ কাজ নয়। কিন্তু সেটা ছাড়া গণতন্ত্র এগিয়ে যেতে পারে না।