অধিকাংশ মানুষের মন স্বাধীনভাবে ডানা মেলতে চায় মুক্তবিহঙ্গের মতো। পাখি যেমন ডানা দিয়ে আকাশে প্রাণখুলে উড়তে পারে, তেমনি মানুষও এমন একটা পৃথিবী খোঁজে, যেখানে নিশ্চিন্তে স্বাধীনভাবে নিজেকে মেলে ধরতে পারে। নিজের অবস্থান, চিন্তা-চেতনা, মতামত, আদর্শ সবকিছু নিজের মতো করে প্রকাশ ও প্রতিষ্ঠিত করতে চাওয়ার একটা সুপ্ত বা প্রকাশ্য ইচ্ছে থাকে সবার মধ্যে। কিন্তু সব মানুষ কি তা কার্যকর করতে পারে?
নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও যতটুকু পারা যায়, তাতেও নানা ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হয়। নিজের অবস্থান দৃঢ় করে সৎভাবে কোনো মতামত প্রতিষ্ঠিত করতেও নানা দুর্ভোগে কমবেশি ছেলে-মেয়ে উভয়কেই ভুগতে হয়। তবে সমাজের কারণে মেয়েদের ক্ষেত্রে ভোগান্তির ব্যাপারটি একটু বেশিই হয়। তাই নিজের জন্য স্বস্তি আর শান্তির জায়গাটা খুঁজে নিতে পারাটা সবার আগে দরকার। সমাজে প্রতিষ্ঠিত নারীবাদ বা পুরুষতন্ত্রের ব্যাপারগুলো একটু দূরে সরিয়ে রেখে একদম গোড়া থেকে ভাবা যেতে পারে। দিন বদলালেও এখনো যে আমরা ‘গোড়ায় গলদে’র খেসারত দিচ্ছি, নানা ঘটনায় তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
একটা মেয়ে শিক্ষিত ও কর্মজীবী এবং তিনি প্রতিবাদীও। সব ক্ষেত্রে অন্যায়ের প্রতিবাদ করাটা তাঁর স্বভাবসুলভ। কিন্তু বাস্তবে প্রতিবাদী হলেও, তিনি ঘরের মধ্যে প্রতিবাদ করতে পারেন না; বিশেষ করে বিয়ের পর। যে মেয়েটাকে দেখা যায় ঘরে-বাইরেসহ নানা দিক সামলে অন্যকে অনায়াসে সমস্যার সমাধান বলে দিতে পারছেন, সেই তিনিই আবার নিজের ঘরে তা করতে পারছেন না। যে মেয়েটা চারপাশের সব মেয়ের আদর্শ, দিনশেষে একটা জায়গায় গিয়ে সেই মেয়েটাই ‘আরেকটু দেখি’—এ কথায় গিয়ে থেমে যাচ্ছেন।
মা-বাবার বাড়িতে যতটুকু বলা সম্ভব হলেও শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে তার চেয়ে অনেক বেশি থামতে হয়। ওই যে গোড়ায় গলদ। অন্যায় মেনে না নেওয়া, অন্যায় আবদার বা জোর করে মেনে না নেওয়া মেয়েটাও নিজেই কখন যেন কত কিছু মেনে নেন। কিছুদিন বা আজীবন ধরে।
কারও কথায় কান না দেওয়া মেয়েটিও অন্যের কথায় কান দিয়ে অথবা অবচেতন মনেই দুবার হলেও ভাবেন সংসার তো, ‘আরেকটু দেখি’। এই আরেকটু দেখতে দেখতে কেউ কেউ জীবনের শেষ মুহূর্তে গিয়ে পৌঁছান। আর কেউ কেউ একটা সময় পরে সেই শেকল ভেঙে বেরোতে পারেন।
একটা সময় আলগা বাঁধন খুলে নিজের মতো করে বাঁচতে পারেন। নিজের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন। তবে শুরুতে কজন পারেন? সেই তো ‘একটা সময়’ পেরিয়ে এসে। যে সময়টা হয়তো তাঁর জন্য জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যে সিদ্ধান্তটা তাঁর জন্য সে সময় নেওয়াটা বেশি জরুরি ছিল। অনেকের সংসারে মায়ার বন্ধন যেমন আছে, আবার তেমনি অনেক সংসারে গ্লানি ছাড়া কিছু নেই।
এরপর আত্মসম্মান শেষ হতে না দিয়ে অনেকটা পথ পেরিয়ে যখন সব গ্লানি থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারে, মেয়েটা হয়তো ম্লান হেসে মনে মনে ভাবেন—এই আমিই এত দিন মানিয়ে নিয়েছি! অথচ আমার ক্ষেত্রে শুরুতেই এটা করার কথা ছিল। কথাগুলো এক পক্ষীয় মানিয়ে বা মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে। কারণ সঠিক বিচারে দ্বিপক্ষীয় ভাবনাটাও থাকা দরকার। অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে হয় নিজে টিকবেন, না হলে আত্মসম্মান টিকবে। কিন্তু দুটিই হারালে জীবন অনর্থক।
আত্মসম্মান এমন একটা জিনিস, যেটা চলে গেলে আর নিজের অস্তিত্ব বলে কিছু থাকে না। তাই নিজের অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখতে শুরুটা সঠিক হওয়া উচিত, যেন আর শেষে মাশুল বা হা হুতাশ করতে না হয়। শেষে গিয়ে ভাবতে না হয়—এটা তো আমি না! যে কটা দিন মানিয়ে নেওয়ার জন্য নিজের সঙ্গে নিছক লুকোচুরি করতে হয়েছিল, সেই কটা দিনের ভুল যেন জীবনে না করতে হয়। একটাই তো জীবন। এটাকে জটিল করে ফেলার কোনো মানে হয় না। জটিল মানুষ, জটিল পরিবেশ এড়িয়ে সহজ করে ভাবার জন্য প্রকৃতি আমাদের অনেক সুযোগ করে দিয়েছে। শুধু দরকার ইতিবাচকভাবে সবকিছু গ্রহণ করার মানসিকতা।
জীবনের যেকোনো প্রান্তে এসে খুব আপনজন ভাবা কেউ আপনার পাশে না থাকতে পারে, হাত ছেড়ে দিতে পারে। কিন্তু নিজের তৈরি করা অবস্থান কখনো হাত ছেড়ে দেয় না। তাই নিজের একটা অবস্থান ও পরিচয় তৈরি করা শুধু জরুরি না, এটা আবশ্যকও। সামাজিক কারণে একটা ছেলে প্রথাগতভাবেই এটা তৈরি করে নেয়। মেয়েদের ক্ষেত্রে অন্তত এই প্রথাটা সত্যিই আবশ্যক। পরিচয় তৈরি করতে সব সময় শিক্ষিত বা ডিগ্রি জরুরি না, কোনো না কোনো দক্ষতা কমবেশি সবার থাকে। শুধু সেটুকু নিয়ে, আত্মবিশ্বাস নিয়ে নামুন, দেখবেন জীবন কত সহজ ও সুন্দর।
লেখক: সাংবাদিক