কল্পকাহিনির অনেক চরিত্রের অনুপ্রেরণা বাস্তবের কোনো মানুষ। স্যার আর্থার কোনান ডয়েলও তাঁর বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র শার্লক হোমস চরিত্রটি সৃষ্টি করেছেন বাস্তবের একজন মানুষে অনুপ্রাণিত হয়ে। কোনান ডয়েলের ৯৪তম মৃত্যুবার্ষিকীতে সেই মানুষের গল্পই জানাব আজ।
তবে মূল লেখা শুরুর আগে বরং স্যার আর্থার কোনান ডয়েলকে নিয়ে দু-চারটি কথা বলা যাক। ১৮৫৯ সালের ২২ মে স্কটল্যান্ডের এডিনবরায় জন্ম তাঁর। এই ব্রিটিশ লেখক এবং চিকিৎসক নানা ধরনের গল্প-উপন্যাস রচনা করলেও তাঁকে দুনিয়াজোড়া খ্যাতি এনে দেয় শার্লক হোমসই। এই গোয়েন্দা চরিত্র নিয়ে ডয়েল লেখেন চারটি উপন্যাস এবং ৫৮টি ছোট গল্প। ১৮৮৭ থেকে ১৯২৭ সালের মধ্যে প্রকাশিত হয় এগুলো।
এ ছাড়া কোনান ডয়েলের আরেকটি খুব জনপ্রিয় চরিত্র প্রোফেসর চ্যালেঞ্জার। ডয়েলের বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড’-এর কেন্দ্রীয় চরিত্র এই চ্যালেঞ্জারই। ১৯৩০ সালের ৭ জুলাই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন কোনান ডয়েল।
এবার মূল গল্পে আসা যাক। ড. জোসেফ বেল ছিলেন এডিনবরার এক শৈল চিকিৎসক ও ফরেনসিক গোয়েন্দা। তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণক্ষমতার জন্য নাম ছিল বেলের। রোগীদের চেহারা ও আচরণ দেখে পেশা, কোথায় থাকেন এমন নানা তথ্য দিয়ে কখনো কখনো চমকে দিতেন ছাত্রদের। বেলের এই ছাত্রদের একজন ছিলেন আর্থার কোনান ডয়েল। পাঠক নিশ্চয় বুঝে গেছেন, এই ড. জোসেফ বেলের চরিত্রে অনুপ্রাণিত হয়েই স্যার আর্থার কোনান ডয়েল সৃষ্টি করেন তাঁর অসাধারণ চরিত্র শার্লক হোমস।
১৮৭৭ সালে ইউনিভার্সিটি অব এডিনবরা মেডিকেল স্কুলে জোসেফ বেলের সঙ্গে কোনান ডয়েলের পরিচয়। ডয়েল ওখানে ডাক্তারি পড়ছিলেন আর বেল ছিলেন তাঁর শিক্ষকদের একজন। প্রথম যখন তাঁর একটা লেকচার শোনেন ডয়েল, তখন বেলের বয়স ৩৯। শরীরটা ঝাঁকি দিয়ে প্রতিটি কদম ফেলতেন তিনি, এতে প্রচুর শক্তি ব্যয় হয় বলে মনে হতো। চোখজোড়ায় বুদ্ধির ঝিলিক টের পাওয়া যেত। অসাধারণ একজন শল্য চিকিৎসক হিসেবে নাম কামালেও বেল ছিলেন শখের লেখক, খেলোয়াড় এবং বার্ড ওয়াচার।
খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মানুষটিকে দেখা, রোগীকে পরীক্ষা করা—এসবের ওপর গুরুত্ব দিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য উপসংহারে পৌঁছাতেন বেল সব সময়। কোনান ডয়েল শার্লক হোমসের মধ্যে এসব বৈশিষ্ট্যের বিকাশ ঘটিয়েছেন। তবে কালজয়ী চরিত্রটি যে অসাধারণ এই প্রফেসরে অনুপ্রাণিত, এ নিয়ে কোনো লুকোছাপা করেননি, ‘এতে সন্দেহ নেই যে এ ধরনের একটি চরিত্রের সংস্পর্শে আসার পর, অপরাধীর ভুল নয় বরং নিজের জ্ঞান দিয়ে রহস্য সমাধান করতে পারঙ্গম এমন একজন বৈজ্ঞানিক চিন্তার গোয়েন্দা চরিত্র সৃষ্টিতে আমি তাঁর কৌশল ব্যবহার করেছি।’
প্রফেসরের সঙ্গে কোনান ডয়েলের পরিচয়ের ১০ বছর পর ১৮৮৭ সালে আ স্টাডি ইন স্কারলেটের মাধ্যমে প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে শার্লক হোমসের। ১৮৯১ সালে দ্য স্ট্যান্ড ম্যাগাজিনে চরিত্রটি নিয়ে ছোটগল্পের প্রথম কিস্তি প্রকাশের পর বৃহস্পতি তুঙ্গে উঠে যায় হোমসের। বলা চলে, দুনিয়াজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে তাঁর খ্যাতি। মজার ঘটনা, এই গোয়েন্দায় আগ্রহী ছিলেন স্বয়ং ড. বেলও। এমনকি তাঁর প্রাক্তন ছাত্রকে পরামর্শও দিয়েছিলেন কখনো কখনো, যদিও সেগুলো বাস্তবসম্মত নয় মনে করায় সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেন ডয়েল।
কোনান ডয়েল হোমস চরিত্রটি সৃষ্টির পেছনে বেলের অবদানের কথা সব সময় বললেও লিটল জনের কথা প্রথম উল্লেখ করেন এই ফরেনসিক বিশেষজ্ঞের মৃত্যুর কয়েক বছর বাদে, ১৯২৯ সালে। এর এক বছর বাদে অবশ্য কোনান ডায়েল নিজেই মারা যান। ১৯২৯ সালে কেনিয়ার নাইরোবি ভ্রমণের সময় প্রথম তিনি উল্লেখ করেন, বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তা-ভাবনা থেকে একটি গোয়েন্দা চরিত্র সৃষ্টির বিষয়ে বেল ও লিটল জনের কৌশল প্রথম উৎসাহী করে তোলে তাঁকে।
যাক, আবার ফিরে আসা যাক বেলের প্রসঙ্গে। হোমসের জনপ্রিয়তা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠেন বেলও। এডিনবরা পুলিশ একপর্যায়ে রহস্য সমাধানে তাঁর সাহায্য চেয়ে বসে। ১৮৮৮ সালে কুখ্যাত সিরিয়াল কিলার জ্যাক দ্য রিপারের তালাশের সময়ও জোসেফ বেলের পরামর্শ নেয় স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড। কথিত আছে, বেল এমনকি একজন সন্দেহভাজনের নাম জানিয়েছিলেনও, তবে সেটা জনসমক্ষে আনা হয়নি।
তবে বেল কখনোই হোমসের সঙ্গে তাঁকে মেলানোর পক্ষপাতি ছিলেন না। অসাধারণ মস্তিষ্ক ছাড়া বেল ও হোমসের চরিত্রগত মিলও ছিল কমই। চেহারা-সুরতেও বিস্তর ফারাক ছিল। তা ছাড়া হোমসের মতো অগোছালো ছিলেন না বেল মোটেই। কোকেনে আসক্তি ছিল না তাঁর, তেমনি ভায়োলিনও বাজাতেন না। তাই চরিত্র সৃষ্টির সমস্ত কৃতিত্ব দিয়েছেন ছাত্রকেই।
সূত্র: দ্য আর্থার কোনান ডয়েল এনসাইক্লোপিডিয়া, উইকিপিডিয়া, অ্যামেরিকান ইউরোলজিকেল অ্যাসোসিয়েশন, পাবলিশার উইকলি ডট কম