আতশবাজির ইতিহাস আজকের নয়। কেউ কেউ বলেন, এর প্রচলন প্রথম চীনে। দুই হাজার বছর আগে হান রাজবংশের রাজত্বকালে প্রথম এর প্রচলন হয়। তখনকার মানুষ ধারণা করত বন্যা-খরা-অনাবৃষ্টি প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটে অপদেবতাদের কারণে। আতশবাজি ফাটিয়ে, আকাশের দিকে বাজি-পটকা ফুটিয়ে অপদেবতাদের ভয় দেখাত তারা। সেখান থেকেই আতশবাজির শুরু। পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি আতশবাজি ব্যবহৃত হয় ভারতে দীপাবলির সময়। এ ছাড়া চীন ও তাইওয়ানে লণ্ঠন উৎসবের সময়, যুক্তরাজ্যে ফকস নাইটে, আমেরিকায় স্বাধীনতা দিবসে আর ফ্রান্সে বাস্তিল দিবসে। এ ছাড়া পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই বর্ষবরণ উৎসবের সময় আতশবাজি ফোটানো হয়। কিছুদিন আগে ব্যতিক্রম হয়নি আমাদের দেশেও।
এখন আতশবাজির এতটাই কম্পন যে শুধু অপদেবতা নয়, পশুপাখি এমনকি মানুষ ও প্রাকৃতিক পরিবেশও এর থেকে রেহাই পাচ্ছে না। বাজি-পটকার মধ্যে থাকে পটাশিয়াম ক্লোরেট, পটাশিয়াম নাইট্রেট অথবা সোডিয়াম নাইট্রেট। এর সঙ্গে মেশানো থাকে কাঠের গুঁড়া, সালফার ইত্যাদি। অত্যন্ত দাহ্য পদার্থ হওয়ায় আগুনের সংস্পর্শে এসে এসব জ্বলতে থাকে। আতশবাজির ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে অনেক। এটি শুধু শব্দদূষণই করে না, বিভিন্ন গ্যাস নিঃসরণের মাধ্যমে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। এর ভয়াবহ শব্দের কারণে শিশু ও বয়স্কদের হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এখান থেকে কার্বন মনো-অক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেনযুক্ত গ্যাস সৃষ্টি হয়। এসব গ্যাস পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
একটি তথ্যমতে, ২০১০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আরকানসাস অঞ্চলে বর্ষবরণের সময় আতশবাজির কারণে প্রায় ৫ হাজার পাখি মারা গিয়েছিল। ২০২১ সালে ইতালির রোমে বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে আতশবাজির কারণে বিকট শব্দে কয়েক হাজার পাখি হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যায়। ২০২১ সালে ফানুস থেকে আগুন লেগে জার্মানিতে একটি চিড়িয়াখানার অনেক পশু মারা গিয়েছিল। ২০১৩ সালে ফানুস থেকে আগুন লেগে যুক্তরাজ্যের একটি প্লাস্টিক কারখানা পুড়ে গিয়েছিল। ২০১৫ থেকে ২০১৭ সালে করা একটি গবেষণা তথ্য অনুযায়ী, আতশবাজির পরে চীনের ৩৩৫টি শহরের বায়ুমান সূচক ৫৭ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে এবং সালফার ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়েছে ৬৯ শতাংশ।
বাংলাদেশে আতশবাজির কারণে আগুন লাগার ঘটনাও ঘটেছে অনেক। ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের বর্ষবরণে আতশবাজি ও ফানুস ওড়ানোর সময় প্রায় ১০০টি স্থানে আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। ২০২১ সালে একই কারণে আগুন লাগে ১৬টি জায়গায়। ওই বছর উচ্চশব্দের কারণে একটি শিশু মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে। এর আগে ২০২০ সালে একই কারণে আগুন লাগে ৫০টি জায়গায়। আর ২০১৮ সালে লাগে ৪২টি জায়গায়।
আতশবাজির অত্যধিক শব্দে পাখিরা দিগ্ভ্রান্ত হয়ে যায়। ভয়ে ছোটাছুটি করে। কিছু কিছু পাখি এদিক-সেদিক পালাতে গিয়ে বিভিন্ন দেয়ালে ধাক্কা লেগে মারা যায়। ২০২৩ সালে বাংলাদেশে আতশবাজির কারণে ঢাকায় শতাধিক পাখি মারা যায়। রাজধানীর মিরপুর ১৪ নম্বর, বোটানিক্যাল গার্ডেন, গেন্ডারিয়া, ওয়ারী, সদরঘাট, সাতরাস্তা, চিড়িয়াখানা এসব এলাকায় অনেক পাখি মরে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। মরে পড়ে থাকা পাখিগুলোর মধ্যে চড়ুই, কাক অন্যতম। আতশবাজির সময় টিয়া, শালিক প্রভৃতি পাখি ছোটাছুটি করেছে।
২০১২ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, তাইওয়ানে লণ্ঠন উৎসবের সময় পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, লেড ও স্ট্রনসিয়ামের যে মাত্রা বাতাসে পাওয়া গেছে, তা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ১০ গুণ বেশি। ভারতে দীপাবলি উৎসবের পর বাতাসে সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বেড়ে যায়। ২০১৩ সালের একটি গবেষণা তথ্য অনুযায়ী, কলকাতার বাতাসে দীপাবলি উৎসবের পরে অ্যালুমিনিয়াম, জিংক, লেড, ক্যাডমিয়াম, কপার, আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, কোবাল্ট প্রভৃতির অতিরিক্ত উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশের বায়ুমান এমনিতেই খুব নাজুক অবস্থায়। কিছুদিন আগে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত একটি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকার বায়ুমান ঝুঁকিপূর্ণ। বিজ্ঞপ্তিতে দূষিত বাতাসের কারণে সংবেদনশীল মানুষকে অপ্রয়োজনে ঘর থেকে বের না হওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে। বাইরে বের হলে মাস্ক পরে বের হতে বলা হয়েছে। আমরা জানি, বায়ুদূষণের অন্যতম প্রধান উপাদান হলো বাতাসে পিএম বা অতিক্ষুদ্র কণার উপস্থিতি। কোনো স্থানের বাতাসে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার পরিমাণ শূন্য থেকে ৫০-এর মধ্যে থাকলে সেই বাতাসকে ভালো বাতাস বলা যায়। ৫১ থেকে ১০০-এর মধ্যে থাকলে মধ্যম আর ১০১ থেকে ১৫০-এর মধ্যে থাকলে বিপৎসীমার মধ্যে আছে বলে ধরা হয়। ১৫১ থেকে ২০০-এর মধ্যে থাকলে অস্বাস্থ্যকর আর ২০১ থেকে ৩০০-এর মধ্যে হলে খুবই অস্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বায়ুমান ৩০১ থেকে ৫০০-এর মধ্যে হলে তা বিপজ্জনক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আতশবাজি ফোটানো হলে এসব ক্ষুদ্র কণার উপস্থিতি বাতাসে বেড়ে যায়। এসব বাতাসকে দূষিত করে। তাই আতশবাজি ব্যবহারে আমাদের সতর্ক থাকা উচিত।