গত ২৪ আগস্ট এমন এক বার্তা পোস্ট করা হয় ফেসবুকের একটি প্রাইভেট গ্রুপে। কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুরসহ দেশের পূর্বাঞ্চল তখন ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত। প্রায় সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে দুর্গত জেলাগুলো। সেই সময় এই বার্তা অনেকের মনে কিছুটা স্বস্তি ছড়িয়ে দিয়েছিল। যারা বন্যাকবলিত এলাকায় সাধারণ মানুষকে উদ্ধারের আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল, এ গ্রুপ তাদের সমন্বয়ের কাজ করছিল সে সময়।
দুপুর ছাপিয়ে বিকেল হয়ে যাওয়া শরতের বিষণ্ন রোদ তখন ফিকে হতে শুরু করেছে। আহমেদ ইবনে আরিফ আমাদের শুনিয়ে চলেছেন সেই উদ্যমী তরুণ-যুবকদের কথা। যাঁরা পদার্থবিজ্ঞানের প্রাথমিক জ্ঞান আর হাতের কাছে পাওয়া সহজলভ্য প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে সেই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ে মহাজাগতিক তরঙ্গমালায় ভাসিয়ে দিয়েছিলেন, ‘হেল্পলাইনটি এখন লাইভ আছে’।
একটি ফেসবুক গ্রুপ
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গ্রুপ খোলা একটি সাধারণ বিষয়। বিভিন্ন গ্রুপের ভিড়ে ‘অ্যালামনাই অব অল প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ’ নামের একটি গ্রুপ ফেসবুকে বেশ সক্রিয়। এখানে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা যুক্ত হয়েছেন একে অন্যের সঙ্গে। তাঁরা কী করেন? মূলত নিজেদের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান।
গড়ে উঠল নেটওয়ার্ক
আন্দোলন শেষেই শুরু হয় বন্যা। দেশের ক্রান্তিলগ্নে গ্রুপটি সক্রিয় হয়ে ওঠে দুর্গত মানুষের সাহায্যার্থে। আহমেদসহ ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী শিহাব উদ্দিন সানি, মুতাম্মিম মাহমুদ আসিফ, সাকিব খান ছিলেন এই গ্রুপের সদস্য।
যেই ভাবা সেই কাজ। ফাহিমের নেতৃত্বে অ্যামেচার রেডিও নেটওয়ার্কের একটি দল ২২ আগস্ট সন্ধ্যায় ফেনী পৌঁছায়। ফেনীর ১৫ তলা তারা নিবাসের ছাদে বসে বেজ স্টেশন। এরপর ডিসি অফিসে একটি নিয়ন্ত্রণকক্ষ স্থাপন করা হয়। পরদিন আসিফ ও সানি যোগ দেন ফেনীতে। আরও দুটি স্টেশন স্থাপিত হয় মহিপাল আর্মি ক্যাম্প ও অস্থায়ী আর্মি মেডিকেল ক্যাম্পে। এ দলগুলোর উদ্দেশ্য ছিল উদ্ধারকর্মীদের একটি নেটওয়ার্কের মধ্যে নিয়ে এসে ত্রাণ ও উদ্ধার তৎপরতা নিরবচ্ছিন্ন রাখা। উদ্ধারকারীরা কোনো বিপদে পড়লে দ্রুত সহায়তা করা এবং উদ্ধার ও ত্রাণ বণ্টনের সময় নষ্ট হওয়া রোধ করা। এ ক্ষেত্রে ৪টি ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করা হয়েছিল। সেগুলো হলো ইউএইচএফ: ৪৩৪.৫০০ মেগাহার্টজ, ইউএইচএফ: ৪৩৪.৬০০ মেগাহার্টজ, ইউএইচএফ: ১৪৪.৩০০ মেগাহার্টজ এবং ইউএইচএফ: ১৪৪.২০০ মেগাহার্টজ।
এই দলের প্রচেষ্টার একটি বড় অংশ ছিল সেনাবাহিনী এবং ফেনী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের মধ্যে যোগাযোগ তৈরির মাধ্যমে মাঠপর্যায়ে যোগাযোগ স্থাপন করা। কারণ, সেই দুর্যোগের একপর্যায়ে সেনাবাহিনীও নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে পারছিল না। এই দল তাদের ফেনী স্টেশন থেকে সেনাবাহিনীর কাছে তথ্য পাঠানো শুরু করে। সেনাবাহিনীও এই রেডিও স্টেশনের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ চালিয়ে যায়। এতে সেনাবাহিনীর উদ্ধার তৎপরতা দ্রুত ও ঝঞ্ঝাটমুক্ত হয়।
যেভাবে উদ্ধারকাজ চলত
এদিকে ঢাকা থেকেও যাবতীয় সাহায্য করার চেষ্টা চালায় অ্যালামনাই গ্রুপটি। স্টেশন স্থাপনের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর আহমেদ ইবনে আরিফ ও সাকিব খান একটি জরুরি ব্রিফিংয়ে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪টির মতো রেসকিউ টিমকে এই বার্তা জানান। একপর্যায়ে শুধু রেসকিউ টিমের সদস্যদের অবগতির জন্য দেওয়া মিটিং-পরবর্তী সার্কুলেশন নোট ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সেখানে আহমেদ ইবনে আরিফের মোবাইল ফোন নম্বর দেওয়া ছিল। আলাপ চলাকালে তিনি জানান, তাঁর নম্বরে একের পর এক ঝড়ের মতো আসতে থাকে উদ্ধারের অনুরোধ। সেই তথ্য তিনি জানিয়ে দিতেন গ্রুপে। সেখান থেকে জানানো হতো তাঁদের ফেনী হেডকোয়ার্টারে। সেখান থেকে উদ্ধারকর্মীদের জানানো হলে উদ্ধার করা হতো সেই মানুষ কিংবা পরিবারটিকে।
এই পুরো যাত্রার শুরুর কেন্দ্রবিন্দু ছিল একটি অস্থায়ী রেডিও নেটওয়ার্ক, যা ছিল বন্যাদুর্গত ফেনীর অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। এর এক দিক সমন্বয় করা হয়েছিল পুরোনো প্রযুক্তির ওয়াকিটকি দিয়ে। ঢাকা থেকে ডেটাবেইস তৈরিতে আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক উদ্ধারকারী দলগুলোর সমন্বয় করতে যোগাযোগ চলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং মোবাইল ফোনে। নতুন-পুরোনো প্রযুক্তির মেলবন্ধনে চলে সামগ্রিক উদ্ধারকাজ আর ত্রাণ তৎপরতা। দলটি এখন বন্যার পুনর্বাসন ধাপ নিয়ে ভাবছে। সেখানে যুক্ত হয়েছেন প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, চিকিৎসক, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ।
ফ্রিকোয়েন্সি
UHF: 434.500mhz Base to Base
UHF: 434.600mhz Base to Handy
VHF: 144.300mhz Base to Base
VHF: 144.200mhz Base to Handy
HF: 14.185mhz & 7.105mhz
GCm: 144.500mhz & 434.700mhz (distress call)